অর্থনীতি

ইলিশের দাম বেঁধে দেওয়া সম্ভব কি? ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ

Advertisement

বাংলাদেশে ইলিশ মাছের নাম শুনলেই বাঙালির মনে জাগে শীতের শুদ্ধ নোনা স্বাদ, ভাতের সঙ্গে মিলিয়ে একেবারে ভোজের আনন্দ। কিন্তু আজকাল ইলিশ মাছ কেনা যেন অনেক পরিবারের জন্য স্বপ্নের বিষয়। দৈনন্দিন আয়ের তুলনায় ইলিশের দাম এতটাই বেড়ে গেছে যে, এক কেজি ইলিশ কিনতে গেলে অনেকের পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছের দাম এখন ২,০০০ থেকে ২,৪০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। আবার ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রামের ইলিশের কেজির দাম ১,৪০০ থেকে ১,৮০০ টাকা। তুলনায়, ইলিশের উৎপাদন মূলত সমুদ্র থেকে আসে প্রায় ৬০ শতাংশ, বাকি ৪০ শতাংশ নদী ও মোহনা থেকে আহরণ করা হয়।

এমন দাম বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। ট্যারিফ কমিশন ইলিশের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ার ১১টি কারণ তুলে ধরেছে।

ইলিশের দাম বৃদ্ধির মূল কারণ

১. চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা: ইলিশের চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ তা মেলাতে পারছে না।
২. মজুদ ও সিন্ডিকেট: কিছু দালাল ও সিন্ডিকেট মজুদ রেখে বাজারে কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করছে।
৩. পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি: মাছ সমুদ্র বা নদী থেকে বাজারে আনার খরচ বেড়েছে।
৪. মাছ ধরার খরচ বৃদ্ধি: জেলেদের ফিশিং খরচ বেড়েছে, বিশেষ করে জাল ও জাহাজের দামে।
৫. পরিবেশগত কারণ: নদী ও সমুদ্রের দূষণ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে মাছের প্রজনন হ্রাস পাচ্ছে।
৬. অবৈধ জালের ব্যবহার: নিষিদ্ধ জালের কারণে ইলিশ প্রজনন হ্রাস পায়, যা বাজারে সরবরাহ কমায়।
৭. দাদন চক্র: বড় আকারের ইলিশ বাজারে আনার জন্য দাদন চক্র প্রায় নিয়ন্ত্রণ করে।
৮. মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব: পাইকার ও আড়তদারের কারণে সরাসরি জেলেদের আয়ের তুলনায় বাজারে দাম বেশি হয়।
৯. রফতানি: ইলিশের রফতানি বাড়লে দেশের ভোক্তাদের জন্য সরবরাহ কমে যায়।
১০. প্রাকৃতিক দুর্যোগ: নদী বা সমুদ্রের বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইলিশ আহরণে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
১১. অনিয়ম ও দুর্নীতি: সরকারি তদারকি থাকলেও পর্যায়ক্রমিক অনিয়ম ও দুর্নীতি বাজারে প্রভাব ফেলে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ইলিশের দাম ৫৭ শতাংশ বেড়েছে।

ভোক্তাদের দুশ্চিন্তা

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, “চাষের মাছের উৎপাদনেও ৪০০ টাকায় ভালো মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু ইলিশের জন্য কোনও উৎপাদন খরচ নেই। তবু দাম এত বেশি। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী ইলিশ স্বাদ হারাচ্ছে সিন্ডিকেট ও দাদন চক্রের কারণে। আমাদের প্রথম দায়িত্ব হলো এ চক্র ভাঙা।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইলিশ মাছের বাজার স্বাভাবিক করতে সরকারের উদ্যোগে ১৩ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।

ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ

ট্যারিফ কমিশন ইলিশ মাছের দাম নিয়ন্ত্রণ ও বাজার স্বচ্ছতার জন্য বিভিন্ন সুপারিশ দিয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  1. জেলেদের সমবায় সমিতি গঠন: জেলেদের স্বার্থ রক্ষায় সমবায় সমিতি গঠন করা।
  2. অনলাইন বিক্রয় প্লাটফর্ম: সরাসরি বাজারে বিক্রয়ের জন্য ডিজিটাল প্লাটফর্ম তৈরি।
  3. সরকারি বিপণন কেন্দ্র: মাছ বিক্রির জন্য সরকারি ওয়ার্কশপ ও বিপণন কেন্দ্র স্থাপন।
  4. আড়তদার ও পাইকারদের করের আওতায় আনা: মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ব কমানোর জন্য কর নীতি প্রয়োগ।
  5. সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা: জেলেদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান।
  6. মাছের আকার অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ: ছোট, মাঝারি ও বড় ইলিশের জন্য আলাদা দাম নির্ধারণ।

আইনি সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবতা

সফিকুজ্জামান বলেন, “সরকারের যতগুলো মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোর মধ্যে ইলিশের দাম নির্ধারণ করার জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট আইন নেই। যেহেতু আইনি কাঠামোর মধ্যে নেই, তাই ইলিশের দাম কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।”

এটি একটি স্পষ্ট সংকেত যে, শুধুমাত্র সুপারিশ দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। প্রয়োজন আইনি ব্যবস্থা, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এবং ভোক্তাদের সচেতনতা।

ইলিশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

ইলিশ শুধু একটি মাছ নয়। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

  • অর্থনৈতিক দিক: মাছ আহরণ, পরিবহন ও বিক্রিতে জেলেদের এবং আড়তদারদের livelihoods জড়িত।
  • সাংস্কৃতিক দিক: বাঙালির উৎসব, পিঠা ও ভাতের সঙ্গে ইলিশের সম্পর্ক গভীর। বিশেষ করে শীতকালে ইলিশ খাওয়ার রীতি হাজার বছরের।

ভোক্তারা মনে করেন, ইলিশের বাজারে স্বচ্ছতা ও নিয়মিত তদারকি আনতে হবে। “ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ, এর স্বাদ বাঙালির জন্য অভিন্ন। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণ, সিন্ডিকেট বন্ধ ও সরকারি তদারকি জরুরি,” বলেন ক্যাব সভাপতি।

বাজারে সম্ভাব্য পরিবর্তন

বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে ইলিশের দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। তবে, এটি কার্যকর করতে হলে কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে:

  1. মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ব বন্ধ করা।
  2. জেলেদের স্বার্থ রক্ষা ও সমবায়িক ব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়ন।
  3. সরকারি বিপণন কেন্দ্র ও অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে সরাসরি বাজারে মাছ পৌঁছানো।
  4. আইনি কাঠামো তৈরি করে দাম নির্ধারণের সুযোগ করা।

এছাড়া, ভোক্তাদের সচেতনতা ও বাজারে প্রতারণা চিহ্নিত করার ক্ষমতাও বৃদ্ধি করতে হবে।

ইলিশ মাছের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কেবল একটি অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এটি সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক দায়িত্ব। সঠিক নীতি, আইনি কাঠামো, স্বচ্ছ বাজার ও ভোক্তাদের সচেতনতা থাকলে, দেশের জাতীয় মাছ ইলিশ আবার বাঙালির ভোজনের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে আসতে পারে।

ভোক্তারা আশা করছেন, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে। যাতে আগামী দিনে ইলিশ মাছের স্বাদ আরেকবার সবার টেবিলে ফিরে আসে, এবং এটি শুধুমাত্র ধনীর জন্য নয়, সাধারণ মানুষেরও পক্ষে সহজলভ্য হয়।

MAH – 13130 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button