গাজামুখী ত্রাণবাহী নৌবহর “সুমুদ ফ্লোটিলা”-তে হামলা চালিয়ে অন্তত আটটি জাহাজ জব্দ করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। আটক করা হয়েছে দুই শতাধিক মানবাধিকার কর্মীকে, যাদের মধ্যে রয়েছেন সুপরিচিত সুইডিশ পরিবেশবাদী কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ শুরু হয়েছে।
এই বহরে ছিল চিকিৎসা সামগ্রী, খাদ্য, জরুরি সহায়তা এবং গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি।
আটক হওয়া জাহাজ ও স্বেচ্ছাসেবীরা
আল-জাজিরার খবরে জানা যায়, আটক হওয়া জাহাজগুলোর নাম—
- দেইর ইয়াসিন
- হুগা
- স্পেকটার
- আদারা
- আলমা
- সাইরিয়াস
- অরা
- গ্রান্ডে ব্লু
প্রত্যেকটি জাহাজেই ছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, স্বেচ্ছাসেবক এবং চিকিৎসক। বাংলাদেশের পক্ষে পরিচিত আলোকচিত্রী শহিদুল আলমও এই বহরের সঙ্গে ছিলেন।
ইসরায়েলের বাধা উপেক্ষা করে এখনও চলমান দুটি জাহাজ
ইসরায়েলের বাধা উপেক্ষা করে এখনো গাজার দিকে অগ্রসর হচ্ছে “মেটেক” ও “অল” নামের দুটি জাহাজ। বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টার দিকে তারা গাজা উপত্যকা থেকে প্রায় ১১১ কিলোমিটার দূরে ছিল। তবে সর্বশেষ অবস্থান এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গ্রেটা থুনবার্গ কেন যুক্ত হলেন এই মিশনে?
সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ ২০১৮ সালে স্কুল ধর্মঘট আন্দোলনের মাধ্যমে বৈশ্বিকভাবে আলোচনায় আসেন। জলবায়ু আন্দোলনের এই তরুণ নেত্রী সব সময় মানবিক সংকট এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সক্রিয়।
তিনি বলেছেন— “গাজার শিশুদের খাদ্য ও চিকিৎসার অধিকার আছে। মানবিক সহায়তা আটকে রাখা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।”
গ্রেটার উপস্থিতি এই ফ্লোটিলাকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও বেশি আলোচনায় নিয়ে এসেছে।
ফ্লোটিলা আন্দোলনের ইতিহাস
গাজার অবরোধ ভাঙার জন্য “ফ্লোটিলা” উদ্যোগ নতুন নয়।
- ২০১০ সালে “মাভি মারমারা” নামে একটি তুর্কি জাহাজে ইসরায়েলি নৌবাহিনীর হামলায় ১০ জন কর্মী নিহত হয়।
- এরপর থেকেই বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীরা ফ্লোটিলা পাঠিয়ে গাজায় ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা করে আসছেন।
- ইসরায়েল সব সময় দাবি করে আসছে যে এসব বহরে “অস্ত্র” থাকতে পারে, তবে বহুবারই প্রমাণিত হয়েছে এগুলো ছিল কেবল মানবিক সহায়তা।
বাংলাদেশি আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের বক্তব্য
শহিদুল আলম জানিয়েছেন, “আলমা” নামের জাহাজটি সরাসরি ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছে। তিনি বলেন,
“আমাদের লক্ষ্য ছিল গাজার সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসা ও খাদ্য পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনী আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করে আমাদের জাহাজে হামলা চালিয়েছে।”
ইসরায়েলের অবস্থান
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, ফ্লোটিলা অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করেছে, যা তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাই জাহাজগুলো আটক করা হয়েছে। তবে তারা এটিও স্বীকার করেছে যে আটক হওয়া জাহাজগুলোতে অস্ত্র পাওয়া যায়নি।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
- জাতিসংঘ: মহাসচিব জানিয়েছেন, মানবিক ত্রাণ আটকে রাখা “অমানবিক” এবং আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন: অবিলম্বে স্বেচ্ছাসেবকদের মুক্তি ও ত্রাণ সামগ্রী গাজায় পৌঁছাতে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
- তুরস্ক, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা: তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলকে “মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী রাষ্ট্র” আখ্যা দিয়েছে।
- বাংলাদেশ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং শহিদুল আলমসহ আটক সকলকে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
গাজায় মানবিক সংকট
ইসরায়েলি অবরোধ ও অব্যাহত হামলায় গাজার পরিস্থিতি ভয়াবহ।
- প্রায় ২৩ লাখ মানুষ খাদ্য ও ওষুধ সংকটে ভুগছে।
- হাসপাতালগুলোতে বিদ্যুৎ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
- শিশু ও নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
সুমুদ ফ্লোটিলা ঠিক এই সংকট মোকাবিলার জন্যই গঠিত হয়েছিল।
বিশ্লেষণ: আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন?
বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
- আন্তর্জাতিক জলসীমায় মানবিক সহায়তাবাহী জাহাজ আটক করা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
- ইসরায়েল নিরাপত্তার অজুহাত দেখালেও মানবিক ত্রাণ আটকে দেওয়া কোনোভাবেই বৈধ নয়।
- দীর্ঘদিন ধরে গাজায় আরোপিত অবরোধ কার্যত “সমষ্টিগত শাস্তি”, যা আন্তর্জাতিকভাবে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
বিশ্বজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রেটা থুনবার্গ ও অন্যান্য মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তির দাবিতে ঝড় উঠেছে। হ্যাশট্যাগ #FreeTheFlotilla, #StandWithGaza, #FreeGreta এখন ট্রেন্ডিংয়ে।
ইসরায়েলি হামলার শিকার হয়ে সুমুদ ফ্লোটিলার মানবিক মিশন ব্যাহত হলেও এ ঘটনা নতুন করে বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গ্রেটা থুনবার্গসহ আটক হওয়া কর্মীদের মুক্তি এবং গাজায় ত্রাণ পৌঁছানোর অনুমতি দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ আরও জোরদার হচ্ছে।
মানবিক সহায়তা থামিয়ে রাখা যায় না—এই বার্তাই এখন ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে।
MAH – 13122 I Signalbd.com



