
দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ২০০ জনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ৪৯০ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৪২ জন, বরিশাল বিভাগে ১৩৮ জন, ঢাকা বিভাগে ১০০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৬০ জন, ময়মনসিংহে ২৮ জন এবং রংপুরে ২২ জন ভর্তি হয়েছে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০৪ জন পুরুষ এবং ৯৬ জন নারী। এছাড়া চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট ৪৭,৮৩২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও বৃদ্ধি
ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাল রোগ, যা মূলত এডিস মশা মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। এডিস মশা দিন ও রাতে উভয় সময় মানুষকে কামড়াতে সক্ষম, তবে সকালের এবং বিকেলের সময় সবচেয়ে সক্রিয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সাধারণত হঠাৎ জ্বর, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, চোখের পেছনের ব্যথা, বমি, জন্ডিস বা চর্মরোগ দেখা দেয়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ির আশেপাশে জমে থাকা পানি এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে বকুল, খোলা ট্যাংক, আবর্জনা ও ব্যবহৃত পাত্রে জমে থাকা পানি মশা বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
ডেঙ্গুর নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন নেই, তবে শুরুর দিকে সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি হলে রোগীর মৃত্যু হার অনেকাংশে কমানো যায়। চিকিৎসকরা মূলত ফ্লুইড থেরাপি, শরীরের জলীয় ভারসাম্য বজায় রাখা, জ্বর ও ব্যথা কমানো এবং প্রয়োজনে রক্তপরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর শারীরিক অবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করেন।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:
- প্রচুর পানি পান করে শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা
- বিশ্রাম নেওয়া ও হালকা খাবার খাওয়া
- জ্বর বা ব্যথার জন্য ডাক্তারের পরামর্শে প্যারাসিটামল নেওয়া, অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন না নেওয়া
- চোখে বা শরীরে র্যাশ দেখা দিলে অবিলম্বে হাসপাতাল যোগাযোগ
বড় শহরগুলিতে অবস্থা
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল শহরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অন্য অঞ্চলের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিন শতাধিক রোগী ভর্তি হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, শহরের জলাশয়, খোলা খাল ও আবর্জনাময় স্থানগুলোতে মশা প্রজনন রোধ করা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
চট্টগ্রাম, বরিশাল ও রংপুরের জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা অতিরিক্ত শয্যা ও মেডিকেল সরঞ্জাম প্রস্তুত রেখেছেন। এছাড়াও জনগণকে বাড়ির আশেপাশে জমে থাকা পানি অপসারণ করতে বলা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের ও অফিসগামীদের সতর্কতা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুল, কলেজ ও অফিসের কর্মী যারা প্রতিদিন বড় শহরে যাতায়াত করেন, তারা ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকতে পারেন। তাই হালকা রঙের পোশাক পরা, মশার টিকা ব্যবহার, এবং খোলা জায়গায় মশারি ব্যবহার করাও গুরুত্বপূর্ণ।
ডেঙ্গু রোগী বিশেষভাবে শিশু, বয়স্ক ও কমজোর শরীরের মানুষদের জন্য বিপজ্জনক। তাদের ক্ষেত্রে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি না হলে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পদক্ষেপ
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছে। এছাড়াও তারা:
- নতুন রোগী এবং মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন আপডেট করছে
- শহরের বিভিন্ন এলাকায় মশক নিধন অভিযান চালাচ্ছে
- জনগণকে জলাবদ্ধতা ও আবর্জনা অপসারণে সচেতন করছে
- প্রয়োজন অনুযায়ী হাসপাতালে অতিরিক্ত শয্যা ও ওষুধ সরবরাহ করছে
সম্প্রতি ডেঙ্গু সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক তথ্য
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রতিবছর ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। WHO-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এডিস মশার বিস্তার উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ু এবং শহুরে জলাবদ্ধতার কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে ২০২৫ সালের এই ডেঙ্গু প্রবণতা আগের বছরের তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ বেশি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এই বছরের শেষের দিকে সংক্রমণ আরও বিস্তৃত হতে পারে।
জনগণের জন্য পরামর্শ
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং বিশেষজ্ঞরা জনগণকে কিছু বিশেষ পরামর্শ দিচ্ছেন:
- বাড়ি ও অফিসের আশেপাশে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলুন
- শিশুদের খোলা স্থানে বাইরে খেলতে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করুন
- মশারি ও মশার তেল ব্যবহার করুন
- রোগীর লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগ করুন
- বাড়ির ছাদ ও জলাধার নিয়মিত পরিস্কার রাখুন
ডেঙ্গু এখন শুধু একটি মৌসুমি রোগ নয়, এটি জনস্বাস্থ্য সংকটের পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিন শতাধিক রোগী ভর্তি হচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের সতর্কতা ও জনগণের সচেতনতা মিলিয়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিটি মানুষকে নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে সতর্ক থাকা জরুরি। জলাবদ্ধতা অপসারণ, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করা হলো এই রোগ থেকে বাঁচার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
MAH – 13114 I Signalbd.com