বানিজ্য

বাংলাদেশে বিনিয়োগে বাধার ৫টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করল যুক্তরাষ্ট্র

Advertisement

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ২০২৫ সালের বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিবেশ (Global Investment Climate Report 2025) প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচটি প্রধান বাধা চিহ্নিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সীমাবদ্ধতা কমানোর জন্য কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে বিদেশি বিনিয়োগ এখনো নানা কারণে বাধাগ্রস্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের রিপোর্টে বাংলাদেশ অংশে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও, বিদেশি বিনিয়োগের প্রক্রিয়ায় এখনও উল্লেখযোগ্য সমস্যা রয়েছে। এই প্রতিবেদন গত ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে।

বিদেশি বিনিয়োগের জন্য পাঁচটি মূল বাধা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশে যে পাঁচটি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে, তা হলো:

  1. অপর্যাপ্ত অবকাঠামো:
    বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়ন বেশ কিছু ক্ষেত্রে সীমিত। বিদ্যুৎ, রাস্তা, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে উন্নয়নের অভাব বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রাস্তাঘাট উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু প্রচলিত মানের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে এখনও অবকাঠামো অপর্যাপ্ত।
  2. সীমিত অর্থায়ন ও ব্যাংকিং চ্যালেঞ্জ:
    বিদেশি কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই পর্যাপ্ত স্থানীয় অর্থায়ন বা ব্যাংকিং সুবিধা খুঁজে পান না। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং ঋণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। এ কারণে নতুন বিনিয়োগ শুরু করা প্রায়ই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
  3. আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব ও জটিলতা:
    বাংলাদেশে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া এখনও ধীর এবং জটিল। লাইসেন্স, অনুমোদন, শুল্ক ও অন্যান্য সরকারি কাগজপত্র সংগ্রহে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এতে বিনিয়োগকারীদের জন্য সময় ও খরচ বৃদ্ধি পায়।
  4. বিদেশি সংস্থার জন্য কর ও ফি বোঝা:
    প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি সংস্থাগুলোর উপর কর ও অন্যান্য অর্থনৈতিক বোঝা অনেক ক্ষেত্রে অন্যায্য এবং বেশি। করনীতি প্রায়ই জটিল এবং অপ্রত্যাশিত, যা নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য এক বড় প্রতিবন্ধকতা।
  5. দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব:
    দূর্নীতি এখনও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা। প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না থাকা এবং কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের ইতিবাচক অগ্রগতি

যদিও এসব সমস্যা বিদ্যমান, মার্কিন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সরকার বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে:

  • বিদ্যুৎ ও শক্তি খাতে উন্নয়ন: সরকার বিভিন্ন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে, যা শিল্পাঞ্চলগুলোর জন্য ধারাবাহিক বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সহায়ক।
  • প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উদ্যোগ: বাংলাদেশ আইটি এবং প্রযুক্তি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
  • অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প: নতুন সড়ক, মহাসড়ক, বন্দর ও রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগের সুবিধাজনক পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

তবে মার্কিন রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, দৈনন্দিন নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এখনও হয়নি। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখনও নানা ঝুঁকি ও জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন।

রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগ পরিবেশে প্রভাব ফেলতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে ছাত্র বিক্ষোভ এবং সহিংস দমন-পীড়নের পর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এর ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়।

নতুন সরকার প্রশাসনের সংস্কারের কাজ শুরু করলেও, দৈনন্দিন নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়ার পরিবর্তন এখনও সীমিত। এই পরিস্থিতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপারিশ

মার্কিন রিপোর্টে বাংলাদেশ সরকারের জন্য কিছু সুপারিশও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে:

  • অবকাঠামো উন্নয়নের ত্বরান্বিত উদ্যোগ: বিদ্যুৎ, রাস্তা, বন্দর ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দ্রুতগতিতে করা।
  • বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার সরলীকরণ: লাইসেন্স, অনুমোদন, শুল্ক প্রক্রিয়া এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ সহজ করা।
  • করনীতি সংস্কার: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য কর বোঝা হ্রাস ও প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি।
  • দুর্নীতি হ্রাস ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং অনিয়ম রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি পাবে এবং দেশকে দক্ষিণ এশিয়ার বিনিয়োগযোগ্য গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।

বাংলাদেশের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে রপ্তানি, প্রযুক্তি, শিল্প ও অবকাঠামো খাত বিনিয়োগের জন্য বেশ সম্ভাবনাময়। দেশের যুব সমাজ, প্রযুক্তি দক্ষ জনশক্তি এবং ভৌগোলিক সুবিধা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয়।

যদি সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপারিশ অনুযায়ী অবকাঠামো উন্নয়ন, করনীতি সংস্কার ও প্রশাসনিক জটিলতা হ্রাসে কাজ করে, তবে আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ বিনিয়োগ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০২৫ সালের বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিবেশ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশের চিত্র পরিষ্কার। যদিও কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তবে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সীমিত অর্থায়ন, প্রশাসনিক জটিলতা, করের বোঝা এবং দুর্নীতি প্রধান বাধা হিসেবে রয়ে গেছে।

বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সংকেত যে, সঠিক নীতি, প্রশাসনিক সংস্কার এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করলে দেশ বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও দৃঢ় এবং স্থিতিশীল অবস্থানে পৌঁছাতে পারে।

MAH – 13067 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button