আবহাওয়া

ফিলিপাইনে মৌসুমি ঝড় ‘বুয়ালোই’: নিহত ২৬, নিখোঁজ ১৪

Advertisement

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনে মাত্র কয়েক দিন আগে সুপার টাইফুন রাগাসার আঘাত সামলানোর পরই আঘাত হানে নতুন মৌসুমি ঝড় ‘বুয়ালোই’। এই প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের কারণে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাণহানি, বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এবং বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। ফিলিপাইনের দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তর (NDRRMC) জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ঝড়ে ২৬ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩৩ জন এবং নিখোঁজ রয়েছেন ১৪ জন।

ঝড়ের প্রাথমিক আঘাত ও ক্ষয়ক্ষতি

ঝড় ‘বুয়ালোই’ শুক্রবার রাতে শুরু হওয়া ভারী বর্ষণ এবং ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে আঘাত হানে। ফিলিপাইনের বিভিন্ন প্রদেশে নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি পাহাড়ি এলাকা ও উপত্যকাগুলোতে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে, যা ঝড়ে প্রাণহানির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ফিলিপাইনের দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে:

  • বিকোল প্রশাসনিক অঞ্চল: ৯ জনের মৃত্যু
  • কাগায়ান উপত্যকা: ৮ জনের মৃত্যু
  • কর্ডিল্লেরা প্রশাসনিক অঞ্চল: ৪ জনের মৃত্যু
  • ল্যুজোন প্রদেশ: ২ জনের মৃত্যু
  • ভিসায়াস প্রদেশ: ৩ জনের মৃত্যু

নিহত ও আহতরা মূলত ভারী বর্ষণ, বন্যা এবং ভূমিধসের শিকার হয়েছেন।

বিপর্যয়ের বিস্তার ও উদ্ধারকাজ

ঝড়ের প্রাথমিক সতর্কবার্তা পাওয়ার পরই ফিলিপাইনের দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসন উদ্ধার এবং সুরক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। শুক্র ও শনিবার মোট ৭ লাখ ৩৮ হাজার ৭১৪টি পরিবারকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে, ঝড়ের ধাক্কা কেটে যাওয়ার পরও এখনও ২ হাজার ৬৮০টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন ৪৬ হাজার ৬১১টি পরিবারের মোট ১ লাখ ৬৩ হাজার ৩১৭ জন সদস্য।

এছাড়া, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে মোট ৮ হাজার ৯১৬টি বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে, যা সারা দেশের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির এক বড় অংশ। রাস্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও প্রভাবিত হয়েছে, ফলে উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণে দেরি হচ্ছে।

সরকারী সহায়তা ও ত্রাণ কার্যক্রম

ফিলিপাইনের সরকার তৎপরভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় সরকার ইউনিট এবং জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৪৯ হাজার ৬৭৫টি পরিবারকে ত্রাণ ও এককালীন অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়েছে। খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক এবং অসুস্থদের জন্য আলাদা ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে।

সরকারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঝড়ের পরপরই বিপর্যয়পূর্ণ এলাকা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

ঝড়ের প্রভাব ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট

ফিলিপাইন মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় প্রতি বছর গড়ে ২০–২৫টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। বিশেষ করে জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মৌসুমি ঝড়ের মৌসুমে দেশটি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান এবং উষ্ণ সমুদ্রের জল তাপমাত্রা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি ও শক্তিশালী হওয়ার একটি প্রধান কারণ।

বুয়ালোই ঝড়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ঝড়ের গতিবেগ প্রায় ১৫০–১৮০ কিমি প্রতি ঘণ্টা পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা ঘূর্ণিঝড়কে অত্যন্ত প্রলয়ঙ্করী করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝড়ের তীব্রতা ও ধ্বংসযজ্ঞ আরও বেড়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেশী দেশ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা

ফিলিপাইনের প্রতিবেশী দেশগুলো, যেমন ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়া, ঝড়ের প্রভাব মোকাবেলায় সতর্কতা অবলম্বন করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবিক সংগঠনগুলোও ফিলিপাইনকে জরুরি ত্রাণ সাহায্য পাঠাচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (WFP), রেড ক্রস ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক এজেন্সি খাদ্য, পানি, ওষুধ ও জরুরি সামগ্রী সরবরাহে সহযোগিতা করছে।

সম্প্রতি আঘাত হানা সুপার টাইফুন রাগাসা

মৌসুমি ঝড় বুয়ালোইয়ের আগেই ফিলিপাইনে আঘাত হানে সুপার টাইফুন রাগাসা। রাগাসার ফলে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু এবং প্রচুর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাগাসার ধাক্কা সামলানোর আগেই বুয়ালোইয়ের আঘাত নেমে আসায় স্থানীয় প্রশাসন ও দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তরের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গেছে।

ঝড় মোকাবিলায় করণীয়

বিশেষজ্ঞরা জনগণকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলছেন:

  1. ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে আগে থেকে নিরাপদ স্থানে চলে আসা।
  2. সরকারি নির্দেশনা ও সতর্কবার্তা মানা।
  3. খাদ্য, পানি ও ওষুধের পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করা।
  4. শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থদের জন্য বিশেষ যত্ন নেওয়া।
  5. ঝড়ের পরপরই পানিবদ্ধ এলাকা থেকে সরাসরি প্রবেশ না করা, যাতে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য সংক্রমণ রোধ করা যায়।

ফিলিপাইনে মৌসুমি ঝড় বুয়ালোই দেশের মানুষকে নতুন করে কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলেছে। কয়েকদিন আগে আঘাত হানা সুপার টাইফুন রাগাসার প্রভাব এখনও কাটতে না কাটতে বুয়ালোই আরও ভয়াবহ প্রলয় নিয়ে এসেছে। সরকারি প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং স্থানীয় জনগণের সতর্কতার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব হলেও, স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনা এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

ফিলিপাইনের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই বিপর্যয় মোকাবেলায় একজোট হয়ে কাজ করছে। আগামী কয়েকদিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ঝড়ের পর বন্যা ও ভূমিধসের পরবর্তী প্রভাব এখনও অনুভূত হচ্ছে।

MAH – 13061 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button