বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের সুনাম বিশ্বজোড়া। শুধু স্বাদ আর গুণেই নয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও ইলিশ বাংলাদেশের অন্যতম মূল্যবান সম্পদ। প্রতিবছর শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতীয় বাজারে এই রুপালি মাছের ব্যাপক চাহিদা থাকে। সেই প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর সীমিত পরিমাণে ভারতে ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়ে থাকে।
চলতি বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালে ভারতে ১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছে। তবে এ পর্যন্ত রফতানির অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। অনুমতি পাওয়ার প্রথম ১২ দিনে (১৬–২৭ সেপ্টেম্বর) মাত্র ১৩৬ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে গেছে ৯৯ টন এবং আখাউড়া বন্দর দিয়ে গেছে ৩৭ টন।
রফতানির সময়সীমা ও ব্যবসায়ীদের শঙ্কা
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী, আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ রফতানির সুযোগ থাকবে। হাতে বাকি আছে মাত্র কয়েকদিন। ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এত অল্প সময়ে পুরো ১২০০ টন ইলিশ রফতানি করা সম্ভব হবে না।
তাদের মতে, কয়েকটি কারণে রফতানি শ্লথ হচ্ছে—
- ইলিশের দাম গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
- অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বেশি থাকায় মজুত কম।
- পরিবহন ও শুল্ক সংক্রান্ত জটিলতা।
প্রতি কেজি ইলিশের রফতানি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১২.৫ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,৫২৫ টাকা। ফলে স্থানীয় বাজারে যেখানে দাম আরও বেশি, সেখানে রফতানি করে লাভ কম পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীরা।
গত বছরের অভিজ্ঞতা
২০২৪ সালে সরকার ৭৯টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ২ হাজার ৪৫০ টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেনাপোল ও আখাউড়া স্থলবন্দর মিলিয়ে রফতানি হয়েছিল মাত্র ৬৩৬ টন। অর্থাৎ অনুমতির তুলনায় এক-চতুর্থাংশও পূর্ণ হয়নি।
এই অভিজ্ঞতা থেকে অনেক ব্যবসায়ী আগেই ধারণা করেছিলেন, এ বছরও নির্ধারিত পরিমাণ ইলিশ ভারতে পাঠানো কঠিন হবে।
কেন ইলিশ এত গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশে ইলিশ শুধু একটি মাছ নয়, বরং জাতীয় পরিচয়ের অংশ।
- দেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশই ইলিশ।
- প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিপণনের সঙ্গে যুক্ত।
- জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ সরবরাহ করে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ওড়িশা ও বিহার অঞ্চলে দুর্গাপূজার সময় ইলিশের ব্যাপক চাহিদা থাকে। এ সময় বাংলাদেশি ইলিশ পেতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
রফতানির ইতিবাচক দিক
সরকারের অনুমোদিত এ রফতানি কেবল অর্থনৈতিক সুবিধাই এনে দেয় না, বরং কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখে। প্রতিবছর দুর্গাপূজার সময় সীমিত পরিমাণে ইলিশ রফতানি ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় বাজারে প্রভাব
রফতানির কারণে স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম বাড়বে কি না—এই প্রশ্ন প্রায়ই ওঠে।
- ব্যবসায়ীরা বলছেন, রফতানির জন্য বরাদ্দ ১২০০ টন ইলিশ দেশের মোট উৎপাদনের তুলনায় খুব বেশি নয়।
- তবে স্থানীয় ভোক্তারা মনে করেন, উৎসবের মৌসুমে হঠাৎ চাহিদা বাড়লে বাজারে দামের ওপর চাপ পড়ে।
গত কয়েক দিনে ঢাকার কারওয়ান বাজার, চট্টগ্রামের আড়তসহ বিভিন্ন বাজারে ইলিশের দাম কেজি প্রতি ১,৭০০ থেকে ২,২০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে।
রফতানির রুট ও চ্যালেঞ্জ
ইলিশ রফতানি মূলত দুটি স্থলবন্দর দিয়ে হয়ে থাকে—
- বেনাপোল স্থলবন্দর (যশোর) – সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় এই বন্দর দিয়ে।
- আখাউড়া স্থলবন্দর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) – উত্তর-পূর্ব ভারতের বাজারে ইলিশ পাঠাতে ব্যবহৃত হয়।
তবে রফতানিকারকরা অভিযোগ করছেন, বন্দরে শুল্ক ছাড় প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় সময় নষ্ট হচ্ছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে পরিবহন সমস্যার কারণে চালান আটকে যাচ্ছে।
২০১৯ সালের সিদ্ধান্ত ও বিতর্ক
উল্লেখ্য, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম থাকায় দীর্ঘদিন ইলিশ রফতানি বন্ধ ছিল। তবে ২০১৯ সাল থেকে বিশেষ বিবেচনায় দুর্গাপূজার সময় ভারতে সীমিত পরিমাণ ইলিশ পাঠানোর অনুমতি দেওয়া শুরু হয়।
এ নিয়ে দেশে বিতর্কও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, দেশের সাধারণ মানুষের নাগালে ইলিশ পৌঁছানোই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমিত রফতানি আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বিশেষজ্ঞ মতামত
মৎস্য গবেষকরা মনে করেন—
- টেকসই আহরণ ব্যবস্থা না থাকলে ভবিষ্যতে ইলিশ উৎপাদন হুমকির মুখে পড়তে পারে।
- প্রজনন মৌসুমে ইলিশ রক্ষা, জাটকা সংরক্ষণ এবং জেলেদের সহায়তা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে।
- ইলিশকে শুধু দেশীয় বাজারে সীমাবদ্ধ না রেখে বৈশ্বিক বাজারেও পরিচিত করতে হবে।
বাংলাদেশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে ইলিশ রফতানির ক্ষেত্রে আরও পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যাতে দেশীয় বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজার দুটোই সুষম থাকে।
এবারের দুর্গাপূজায় ভারতে ১২০০ টন ইলিশ রফতানির অনুমতি মিললেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩৬ টন রফতানি হয়েছে। হাতে সময় অল্প থাকায় পুরো অনুমোদিত কোটা পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, উচ্চমূল্য, সীমিত সরবরাহ এবং প্রশাসনিক জটিলতার কারণে রফতানি ব্যাহত হচ্ছে।
তবে যাই হোক, ইলিশ শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতির অংশ নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও গৌরবের প্রতীক। প্রতিবছর দুর্গাপূজার সময় ভারতীয় ভোক্তাদের হাতে এই রুপালি মাছ পৌঁছে দেওয়া দুই দেশের সম্পর্ককেও আরও দৃঢ় করে তুলছে।
MAH – 13058 I Signalbd.com



