বিশ্ব

ঘুষের দায়ে চীনের সাবেক কৃষিমন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড

Advertisement

চীনে আবারও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিলেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। দেশটির সাবেক কৃষি ও গ্রামীণ কল্যাণমন্ত্রী তাং রেনজিয়ান (Tang Renjian) ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। তবে তার সাজা কার্যকর করার আগে দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫) জিলিন প্রদেশের চ্যাংচুন ইন্টারমিডিয়েট পিপলস কোর্ট এ রায় ঘোষণা করে।

চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া (Xinhua) জানায়, তাং রেনজিয়ান ২০০৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সরকারি বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের সময় বিপুল পরিমাণ ঘুষ গ্রহণ করেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, নগদ অর্থ ও সম্পত্তি মিলিয়ে তিনি মোট ২৬৮ মিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ৩৭.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৪১০ কোটি টাকারও বেশি) ঘুষ নিয়েছেন।

কীভাবে ধরা পড়লেন তাং রেনজিয়ান?

২০২৪ সালের শুরুতে চীনের দুর্নীতিবিরোধী নজরদারি সংস্থা সেন্ট্রাল কমিশন ফর ডিসিপ্লিন ইনস্পেকশন (CCDI) তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তদন্তে বেরিয়ে আসে তিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।

  • তিনি সরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগ অনুমোদন দিতে ঘুষ নিয়েছেন।
  • কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ বণ্টনের সময় ঘুষ গ্রহণ করেছেন।
  • ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে জমি বরাদ্দ ও লাইসেন্স প্রদানে সুবিধা দিয়ে বিপুল অর্থ অর্জন করেছেন।

তদন্তের পর গত বছরের নভেম্বরে তাকে চীনের ক্ষমতাসীন দল কমিউনিস্ট পার্টি (CPC) থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর ছয় মাস আগে তিনি পদ থেকেও অপসারিত হন।

সাজা স্থগিত কেন?

চ্যাংচুন আদালত জানিয়েছে, তাং রেনজিয়ান আদালতে নিজের অপরাধ স্বীকার করেছেন এবং তদন্তে সহযোগিতা করেছেন। এজন্য তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে দুই বছরের স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে। চীনের আইনে এই ধরণের সাজা সাধারণত আজীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হয়, যদি না ওই ব্যক্তি আবার গুরুতর অপরাধে জড়ান।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে শি জিনপিংয়ের যুদ্ধ

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান শুরু করেন। তার ভাষায়,

“দুর্নীতি হলো কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে বড় শত্রু।”

২০২০ সালে তিনি আরও বড় পরিসরে শুদ্ধি অভিযান ঘোষণা করেন। শুধু সরকারি কর্মকর্তা নয়, সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রসিকিউটর, বিচারক—সবার ক্ষেত্রেই শুদ্ধি অভিযানের আওতা বাড়ানো হয়।

চীনের ইতিহাসে এটিকে সবচেয়ে ব্যাপক দুর্নীতিবিরোধী অভিযান বলা হচ্ছে। এর ফলে কয়েকশ’ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কারাগারে গেছেন বা সাজা পেয়েছেন।

তাং রেনজিয়ানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার

  • ১৯৬২ সালে জন্ম নেন তিনি।
  • চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় গানসু প্রদেশের গভর্নর হিসেবে ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
  • পরে তাকে কৃষি ও গ্রামীণ কল্যাণ মন্ত্রী করা হয়।
  • দীর্ঘদিন ধরে তিনি দলীয় রাজনীতি ও প্রশাসনে প্রভাবশালী ছিলেন।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার রাজনৈতিক জীবন শেষ হয় দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে।

শুধু তাং রেনজিয়ান নন – আরও অনেকে

চীনে দুর্নীতির অভিযোগে অনেক বড় বড় নেতা ও সামরিক কর্মকর্তার পতন ঘটেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • লি শ্যাংফু – সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
  • ওয়েই ফেংহে – প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পূর্বসূরি।
  • আরও শতাধিক কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ের নেতা।

শুধু বেসামরিক নয়, সেনাবাহিনীও এই অভিযানের বাইরে নয়। চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মির (PLA) একাধিক জেনারেল দুর্নীতির অভিযোগে পদ হারিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া

চীনের এই কঠোর শাস্তির খবর আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

  • পাশ্চাত্য বিশ্লেষকরা বলছেন, শি জিনপিং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও সরিয়ে দিচ্ছেন।
  • তবে অন্যরা মনে করছেন, এই অভিযান চীনা প্রশাসন ও দলকে আরও শক্তিশালী করছে এবং জনসাধারণের আস্থা বাড়াচ্ছে।
  • জাতিসংঘের দুর্নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এটিকে নজিরবিহীন কঠোর শাস্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

চীনের জনগণের প্রতিক্রিয়া

চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম উইবো-তে অনেকেই এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। সাধারণ মানুষ লিখছেন, দুর্নীতির জন্য মৃত্যুদণ্ডই সবচেয়ে উপযুক্ত শাস্তি। আবার কেউ কেউ বলছেন, “আমরা গরিব, তারা বিলাসবহুল জীবনে মজা করেছে—এখন শাস্তি ভোগ করুক।”

তবে সমালোচকরাও রয়েছেন। তারা বলছেন, দুর্নীতি চীনের রাজনৈতিক কাঠামোতেই গেঁথে গেছে। এক-দুজনকে শাস্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

অর্থনীতি ও রাজনীতিতে প্রভাব

দুর্নীতির কারণে শুধু রাজনৈতিক ব্যবস্থাই নয়, চীনের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি প্রকল্পে স্বচ্ছতার অভাব, অনিয়মিত ব্যয়, বাজেট অপচয়—এসব কারণে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।

শি জিনপিংয়ের কড়া পদক্ষেপগুলো একদিকে প্রশাসনকে সতর্ক করছে, অন্যদিকে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের কাছে এক ধরণের নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে, সরকার দুর্নীতিকে সহ্য করবে না।

ভবিষ্যতে কী হতে পারে?

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাং রেনজিয়ানের সাজা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ সাধারণত এই ধরনের মৃত্যুদণ্ড আজীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হয়। তবে এটি একটি প্রতীকী পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে শি জিনপিং বার্তা দিচ্ছেন—দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান অনড়।

চীনের সাবেক কৃষিমন্ত্রী তাং রেনজিয়ানের মৃত্যুদণ্ডের রায় আবারও প্রমাণ করল, শি জিনপিং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও সমালোচকরা এটিকে রাজনৈতিক কৌশল বলে মনে করেন, তবুও বাস্তবতা হলো—এই অভিযান চীনা সমাজে গভীর প্রভাব ফেলছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা—সবাই এখন জানে, দুর্নীতি করলে রেহাই নেই।

MAH – 13055 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button