বাংলাদেশ

টঙ্গীর কেমিক্যাল গুদামে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ ফায়ার সার্ভিসের ইন্সপেক্টর নাঈমের মৃত্যু

Advertisement

গাজীপুরের টঙ্গী শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত সাহারা মার্কেটের একটি কেমিক্যাল গুদামে আগুন নেভানোর সময় দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর খন্দকার জান্নাতুল নাঈম (৩৭) মৃত্যুবরণ করেছেন।

শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টায় রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনার পরও চিকিৎসকরা তার জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হননি।

ঘটনাস্থল ও দগ্ধ হওয়ার পরিস্থিতি

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ২২ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর সাহারা মার্কেটের একটি কেমিক্যাল গুদামে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু করে।

দুর্ঘটনার সময় ইন্সপেক্টর খন্দকার জান্নাতুল নাঈম নেতৃত্বদানকারী দলে ছিলেন। আগুন নেভাতে গেলে তিনি দগ্ধ হন, তার শরীরের ৪২ শতাংশ পোড়া গিয়েছিল। এই দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চারজন সদস্য আহত হন।

এই অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুবরণ করেছেন মোট তিনজন ফায়ার সার্ভিস সদস্য। তাদের মধ্যে:

  • ২৩ সেপ্টেম্বর ফায়ারফাইটার শামীম আহমেদ
  • ২৪ সেপ্টেম্বর ফায়ারফাইটার নুরুল হুদা
  • সর্বশেষ আত্মত্যাগ করেছেন ইন্সপেক্টর জান্নাতুল নাঈম

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারা বলেন, “অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে সবসময় জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে কাজ করতে হয়। নাঈম তার দায়িত্ব পালনকালে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।”

খন্দকার জান্নাতুল নাঈমের জীবন ও শিক্ষা

খন্দকার জান্নাতুল নাঈম ২৪ আগস্ট ১৯৮৮ সালে শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার গড়দুয়ারা ইউনিয়নের খন্দকার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
তার শিক্ষা জীবনটি ছিল ধারাবাহিক ও মেধাবী। তিনি মোল্লার টেক উদয়ন বিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে এসএসসি পাশ করেন এবং ফুলপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট তিনি বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে যোগদান করেন। চাকরি জীবনে তিনি প্রথমে স্টেশন অফিসার হিসেবে মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ ফায়ার স্টেশনে দায়িত্ব পালন করেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর হিসেবে চট্টগ্রাম ও সর্বশেষ টঙ্গী ফায়ার স্টেশনে কর্মরত ছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত ছিলেন এবং এক সন্তানের জনক। তার পিতা খন্দকার মোজাম্মেল হক এবং মাতা দেলোয়ারা বেগম। পরিবার ও সহকর্মীরা নাঈমকে একজন নিবেদিত ও পরিশ্রমী কর্মকর্তা হিসেবে স্মরণ করেন।

ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের ত্যাগ

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা প্রতিনিয়ত জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করেন। ফায়ার সার্ভিসের বর্তমান রেকর্ড অনুযায়ী, দায়িত্ব পালনকালে এখন পর্যন্ত ৫১ জন বীর সদস্য আত্মত্যাগ করেছেন।
নাঈমের মৃত্যু এই গৌরবময় তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সংবাদ সংস্থা কে বলেন,

“খন্দকার জান্নাতুল নাঈম একজন দায়িত্বপরায়ণ ও সাহসী অফিসার ছিলেন। তিনি দেশের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমরা তার পরিবারের পাশে আছি এবং তার ত্যাগকে চিরকাল সম্মান জানাব।”

অগ্নি দুর্ঘটনার কারণ ও সতর্কতা

টঙ্গী শিল্পাঞ্চলে এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড নিয়মিত ঘটছে। বিশেষ করে কেমিক্যাল গুদামগুলোতে সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক তদন্ত অনুযায়ী, আগুনের সূত্রপাত গুদামের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও সংরক্ষিত রাসায়নিক পদার্থের অনিয়ন্ত্রিত সংযোগ থেকে হয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা বলেন,

“এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ, আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও গুদামের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের দায়িত্বশীল সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।”

জাতীয় দায়িত্বের প্রতি অঙ্গীকার

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা শুধু আগুন নেভানোতেই সীমাবদ্ধ থাকেন না। তারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাসায়নিক দুর্ঘটনা, প্রাথমিক চিকিৎসা ও উদ্ধার কার্যক্রমেও নিখুঁত ভূমিকা রাখেন।

খন্দকার জান্নাতুল নাঈমের মত সাহসী অফিসাররা সমাজে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা নতুন প্রজন্মের ফায়ারফাইটারদের জন্য অনুপ্রেরণা।

পরিবারের শোক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

নাঈমের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর পুরো ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ মানুষ গভীর শোক প্রকাশ করেছে।
তার সহকর্মী ফায়ারফাইটাররা বলেন,

“নাঈম একজন অনুপ্রেরণাদায়ক নেতা ছিলেন। তার সাহস এবং দায়িত্ববোধ আমাদের সকলের কাছে উদাহরণ হিসেবে থাকবে।”

স্থানীয় জনগণও তার ত্যাগকে স্মরণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা আমাদের জীবন রক্ষার জন্য নিজেদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে কাজ করেন। খন্দকার জান্নাতুল নাঈমের মৃত্যু সেই মহত্ত্বের প্রতীক। তার আত্মত্যাগ শুধুমাত্র তার পরিবার বা সহকর্মীদের নয়, সমগ্র জাতির জন্য এক গৌরবময় শিক্ষা।

দেশবাসী তার সাহসী ও দায়িত্বপরায়ণ ভূমিকাকে চিরদিন স্মরণ রাখবে। তার মতো বীরদের ত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের নিরাপত্তা ও শান্তির পেছনে কত বড় দায়িত্বশীল মানুষের জীবন নির্ভর করে।

MAH – 13024 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button