
ঢাকার দোহার উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামে ঘটেছে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। পারিবারিক কলহ থেকে শুরু হওয়া উত্তেজনা মুহূর্তেই রূপ নেয় ভয়াবহ সহিংসতায়। এতে প্রাণ হারিয়েছেন একই পরিবারের দুই সদস্য—একজন মা, অপরজন বাবা। আর এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত তাদেরই ছেলে।
ঘটনাটি ঘটেছে বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫) বেলা ১২টার দিকে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পরিবারের অভ্যন্তরীণ বিরোধ দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল। বিশেষ করে জমি-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। সেই কলহের জেরে এক ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনে পরিবারটিতে।
ঘটনার বিবরণ
প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহতদের স্বজনদের বর্ণনা অনুযায়ী, দোহার উপজেলার কুতুবপুর এলাকার বাসিন্দা আইয়ুব আলী হাওলাদার (৫২) ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী জয়গন বেগমের (৪৭) মধ্যে বৃহস্পতিবার দুপুরে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে আইয়ুব আলী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
তিনি প্রথমে কীটনাশক পান করেন। পরে হাতে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে স্ত্রী জয়গন বেগমের উপর এলোপাতাড়ি হামলা চালান। গুরুতর আহত জয়গন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
এমন সময় ঘরে প্রবেশ করেন তাদের ছেলে সাগর। মাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। মুহূর্তেই বাবার হাতের ছুরি কেড়ে নিয়ে তিনিই বাবাকে আঘাত করেন। এতে মারাত্মকভাবে জখম হন আইয়ুব আলী।
স্থানীয়রা দ্রুত মা-ছেলেকে উদ্ধার করে দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক জয়গন বেগমকে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত অবস্থায় আইয়ুব আলীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে পথিমধ্যেই তারও মৃত্যু হয়।
স্বজনদের বক্তব্য
নিহতের স্বজনরা জানিয়েছেন, আইয়ুব আলীর প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকতেই তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী জয়গনের সাথে তার সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না। জমি ও সম্পত্তি নিয়ে প্রায়ই কলহ হতো।
একজন আত্মীয় জানান,
“আইয়ুব আলী মানসিকভাবে অস্থির ছিলেন। পরিবার নিয়ে শান্তি ছিল না তার জীবনে। দীর্ঘদিন ধরেই ঝগড়া চলছিল। শেষ পর্যন্ত এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে তা কেউ ভাবেনি।”
অন্যদিকে জয়গনের আত্মীয়রা দাবি করেন, আইয়ুব আলী আসলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তার আগ্রাসী আচরণই শেষ পর্যন্ত তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য
খবর পেয়ে দোহার থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। দোহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান আলী জানান,
“এটি একটি মর্মান্তিক পারিবারিক ট্র্যাজেডি। আমরা ঘটনাস্থল থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করেছি। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত চলছে এবং আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।”
বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতা: এক ভয়ংকর বাস্তবতা
এ ধরনের পারিবারিক সহিংসতা নতুন নয়। বাংলাদেশে প্রায়ই জমি-সম্পত্তি, আর্থিক অসচ্ছলতা, পারিবারিক মতবিরোধ ও দাম্পত্য কলহের কারণে ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অভাবে এ ধরনের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর শত শত নারী পারিবারিক সহিংসতায় প্রাণ হারান। আবার অনেক পুরুষও স্ত্রী বা সন্তানের হাতে খুন হন। এই ঘটনাটি সেই তালিকায় নতুন সংযোজন।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদা ইয়াসমিন বলেন,
“আমাদের সমাজে এখনও পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কার্যকর সামাজিক বা আইনি কাঠামো নেই। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় জমি ও সম্পত্তি নিয়ে কলহ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় ছোটখাটো ঝগড়াও প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।”
তিনি আরও বলেন,
“মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, পারিবারিক কাউন্সেলিং এবং সামাজিকভাবে মধ্যস্থতা করার ব্যবস্থা থাকলে এ ধরনের ঘটনা কমতে পারে।”
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
কুতুবপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আইয়ুব আলী পরিবারে সবসময়ই অশান্তি বিরাজ করত। প্রায়ই কলহ লেগেই থাকত। স্থানীয় এক প্রতিবেশী বলেন,
“গত কয়েকদিন ধরেই তাদের ঝগড়া বেশি বেড়েছিল। আমরা অনেকবার মিল করানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। আজকে যে এমন হবে, কেউ কল্পনাও করেনি।”
আইনি প্রক্রিয়া
পুলিশ জানিয়েছে, এই ঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হবে। নিহতদের ছেলে সাগরের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। তবে সাগরের আত্মীয়রা বলছেন, সে আত্মরক্ষার জন্যই বাবাকে আঘাত করেছে। ফলে বিষয়টি আদালতে প্রমাণসাপেক্ষে বিচার হবে।
বিশ্লেষণ
দোহারের এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি নয়, এটি গোটা সমাজের জন্য একটি সতর্কবার্তা। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, জমি-সংক্রান্ত বিরোধ ও মানসিক অস্থিরতা কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই ঘটনা।
বাংলাদেশে পরিবারভিত্তিক সহিংসতা ও খুন-খারাপি কমাতে হলে শুধু আইনি পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ এবং পারিবারিক সমস্যার প্রাতিষ্ঠানিক সমাধান ব্যবস্থা।
দোহারের এই ঘটনা সমাজে এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। স্ত্রীকে হত্যার পর ছেলের ছুরিকাঘাতে বাবার মৃত্যু নিঃসন্দেহে বিরল ও মর্মস্পর্শী একটি ঘটনা। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিবার ও সমাজকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
MAH – 13014 I Signalbd.com