
মধ্যপ্রাচ্যের রক্তক্ষয়ী গাজা যুদ্ধ থামাতে এবার সরাসরি উদ্যোগ নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আজ মঙ্গলবার তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে বৈঠকে বসছেন মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। বৈঠকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থাকবে— গাজা যুদ্ধের অবসান, ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার পুনর্গঠন পরিকল্পনা।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট আল-জাজিরাকে দেওয়া এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছেন যে এই বৈঠকে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, জর্ডান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের নেতারা অংশ নেবেন।
ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা
মার্কিন ও ইসরায়েলি গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, ট্রাম্প মূলত একটি বহুপক্ষীয় সমাধান উপস্থাপন করবেন। এতে থাকছে—
- গাজা থেকে ধাপে ধাপে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার।
- আঞ্চলিক দেশগুলোর শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো।
- গাজার পুনর্গঠন ও অর্থায়ন পরিকল্পনা।
- ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা, তবে হামাসকে বাইরে রাখা।
হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই প্রস্তাব ইসরায়েল লিখেনি, তবে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল আগেও বহুবার বলেছে, হামাস নিরস্ত্র না হলে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এক ভাষণে বলেছেন,
“আমরা শান্তির যাত্রায় অংশ নিতে প্রস্তুত। আমরা শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতেও ইচ্ছুক।”
এর আগে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগাল ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সোমবার ফ্রান্সও সেই তালিকায় যোগ দিয়েছে। ফলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে।
গাজা যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র
প্রায় দুই বছর ধরে চলমান গাজা যুদ্ধ ইতিমধ্যেই ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। নিহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
- গাজা সিটিতে প্রতিদিনই চলছে বিমান হামলা ও স্থল অভিযান।
- প্রতিদিন ডজন ডজন সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছেন।
- হাজার হাজার মানুষ দক্ষিণে পালিয়ে যাচ্ছেন।
- দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, বিশেষ করে মার্চে যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি অবরোধ আরও কঠোর হয়েছে।
সম্প্রতি কাতারের মধ্যস্থতায় কিছুটা যুদ্ধবিরতি আলোচনার অগ্রগতি হলেও ইসরায়েলি বাহিনীর কাতারে অবস্থানরত হামাস নেতাদের হত্যা প্রচেষ্টা পরিস্থিতিকে আবার জটিল করেছে।
হামাসের প্রস্তাব
মার্কিন গণমাধ্যম ফক্স নিউজ জানিয়েছে, হামাস সম্প্রতি ট্রাম্পকে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে—
- ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি দেওয়া হবে।
- এর বিনিময়ে অর্ধেক জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
চিঠিটি কাতারের মাধ্যমে ট্রাম্পের হাতে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। যদিও কাতার বা হামাস এখনো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি।
বিশ্লেষকদের মতামত
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের উদ্যোগ মূলত মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা। গত কয়েক মাস ধরে ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা কূটনৈতিক চাপের মধ্যে পড়েছে।
- যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত রেখে ফিলিস্তিনকে একটি স্বীকৃত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে।
- সৌদি আরব ও কাতারের মতো দেশগুলো চাইছে যুদ্ধবিরতি ও পুনর্গঠনকে অগ্রাধিকার দিতে।
- অন্যদিকে মিসর ও জর্ডানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো শরণার্থী সংকট কমানোকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দেখছে।
শান্তি প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা
বহু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এ বৈঠক যদি সফল হয়, তবে এটি হবে মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের অস্থিরতায় একটি নতুন অধ্যায়। তবে বড় প্রশ্ন হচ্ছে—
- ইসরায়েল কি গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারে রাজি হবে?
- ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও হামাসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কীভাবে মিটবে?
- আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পুনর্গঠন ও অর্থায়নে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই নির্ধারণ করবে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা কতটা কার্যকর হবে।
দুই বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লক্ষাধিক আহত ও বাস্তুচ্যুত মানুষ, ভয়াবহ মানবিক সংকট—এই সব কিছুর মধ্যে দাঁড়িয়ে আজকের বৈঠক বিশ্ববাসীর জন্য এক বড় আশার আলো। যদিও বাস্তবতা কঠিন, তারপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আশা করছে, অন্তত একটি টেকসই যুদ্ধবিরতির পথ খুলে যাবে।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে নিউইয়র্কের বৈঠকের দিকে। ট্রাম্প ও মুসলিম বিশ্বের নেতারা কী সমাধান দেন, সেটিই নির্ধারণ করবে গাজা ও ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ।
MAH – 12975 I Signalbd.com