
বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) নিয়ে মিথ্যা ও অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামী কুষ্টিয়া জেলা শাখার নেতা মুফতি আমির হামজা-র বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশে তাঁকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রকাশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে।
এই আইনি নোটিশ পাঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান।
কী ঘটেছিল আসলে?
সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ওয়াজ ও মাহফিলে আমির হামজা দাবি করেন যে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন—
- জাবির আবাসিক হলে নাকি শিক্ষার্থীরা সকালে “মদ দিয়ে কুলি” করে।
- ছাত্ররা শিক্ষকদের “লাঠি দিয়ে পেটায়”।
এই বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ফেসবুক, ইউটিউব এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খানের ভাষ্য অনুযায়ী, এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অবমাননাকর মন্তব্য। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে অর্জিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
আইনি নোটিশে কী বলা হয়েছে?
প্রেরিত নোটিশে স্পষ্ট বলা হয়েছে—
- আমির হামজাকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রকাশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে।
- তাঁর দেয়া বক্তব্য সংবলিত ইউটিউব ভিডিও এবং অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কনটেন্ট মুছে ফেলতে হবে।
- এজন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) কে আনুষ্ঠানিকভাবে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
অন্যথায় তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়ের করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ক্ষোভ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রায় পাঁচ দশক ধরে এখানে অসংখ্য গুণী শিক্ষক-শিক্ষার্থী তৈরি হয়েছেন। দেশ-বিদেশের নামকরা গবেষক, প্রশাসক, লেখক, সাংবাদিক এবং সংস্কৃতিকর্মী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
তাদের মতে, একজন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ধর্মীয় বক্তার মুখে এ ধরনের বক্তব্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেনি, বরং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ভুল বার্তা ছড়িয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।
- অনেকেই লিখেছেন, “একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এমন মিথ্যা রটনা মানহানির শামিল।”
- প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, “জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গৌরব, এর মর্যাদা রক্ষায় প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নিতেই হবে।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের মত
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ দণ্ডবিধি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মিথ্যা, অপপ্রচার বা মানহানিকর বক্তব্য প্রচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন—
“একজন ব্যক্তি নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মিথ্যা বক্তব্য দিতে পারেন না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী-অভিভাবক এতে আহত হয়েছেন। তাই আইনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।”
আমির হামজার অতীত বিতর্ক
মুফতি আমির হামজা পূর্বেও বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে আলোচনায় এসেছেন। ধর্মীয় মাহফিলে উগ্র রাজনৈতিক বক্তব্য, বিভাজনমূলক মন্তব্য এবং ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ আগে থেকেই ছিল।
কুষ্টিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিশেষত তরুণ সমাজকে ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে বিভ্রান্ত করার অভিযোগে তিনি সমালোচিত হয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা
ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না দিলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষক ও প্রশাসনের একাধিক ব্যক্তি জানান, তাঁরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে।
একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন—
“এটি শুধু জাবিকে নয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকেই অপমান করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছানো জরুরি।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষার গুরুত্ব
বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গবেষণা, একাডেমিক উৎকর্ষ ও সংস্কৃতির জন্য পরিচিত। এগুলো নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচার হলে তা শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের গুজব ঠেকাতে দ্রুত প্রশাসনিক ও আইনগত পদক্ষেপ জরুরি।
বিটিআরসির দায়িত্ব
নোটিশে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে মিথ্যা বক্তব্য সম্বলিত কনটেন্ট মুছে ফেলতে বিটিআরসিকে উদ্যোগ নিতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিথ্যা ভিডিও বা বক্তব্য ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। প্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে।
এই ঘটনা আবারও স্মরণ করিয়ে দিল—
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষা করা জাতীয় দায়িত্ব।
- মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মন্তব্য প্রতিহত করতে আইন প্রয়োগ অত্যাবশ্যক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। তাই এর সুনামহানি ঘটায় যে কোনো বক্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা সময়ের দাবি।
MAH – 12973 I Signalbd.com