
আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশেও। ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দেশে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কত টাকা বাড়বে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই সিদ্ধান্ত দেশের ভোক্তা, ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদের মাঝে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সরকারের বৈঠক ও প্রাথমিক সিদ্ধান্ত
আজ সোমবার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। বৈঠক শেষে তিনি কোনো মন্তব্য না করলেও বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ব্যবসায়ীদের দেওয়া প্রস্তাব আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বেশি। তাই তা যাচাই-বাছাই করে যৌক্তিক সমাধান খোঁজা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বৈঠকে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম লিটারে ১০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। তাদের যুক্তি, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি টন ১ হাজার ২০০ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে, যা উৎপাদন ও আমদানির খরচ বাড়াচ্ছে।
আগের দাম কত ছিল
এর আগে ১৩ এপ্রিল সরকার প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৮৯ টাকা এবং পাম তেলের দাম ১৬৯ টাকা নির্ধারণ করেছিল। সেই সময় আন্তর্জাতিক বাজার কিছুটা স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বিশ্ববাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়ে গেছে। ফলে স্থানীয় বাজারেও নতুন সমন্বয় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন।
ব্যবসায়ীদের যুক্তি ও অবস্থান
তেল আমদানিকারক ও রিফাইনাররা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানির খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তাদের মতে, দাম না বাড়ালে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়বেন এবং দীর্ঘমেয়াদে আমদানি ব্যাহত হতে পারে। সেই কারণেই তারা দ্রুত দাম সমন্বয়ের দাবি জানিয়েছেন।
একজন শীর্ষ রিফাইনার জানান, “আমরা যদি এখন দাম না বাড়াই, তাহলে বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হবে। আমাদের উৎপাদন খরচ আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে হবে।”
সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া
অন্যদিকে, সাধারণ ভোক্তাদের মাঝে উদ্বেগ বাড়ছে। ভোজ্যতেল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে অন্যতম। দাম বাড়লে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ওপর। স্থানীয় বাজারে এরই মধ্যে চাল, ডাল, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এর সঙ্গে তেলের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রাজধানীর কাওরান বাজারে তেল কিনতে আসা এক ক্রেতা বলেন, “আগেই বাজার সামলানো মুশকিল হয়ে গেছে। এখন যদি তেলের দাম আরও বাড়ে, তবে সাধারণ মানুষের কী হবে?”
সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও ট্রেড কমিশনের ভূমিকা
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভোক্তাদের স্বার্থ বিবেচনা করে দাম সমন্বয় করা হবে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন বর্তমানে যৌক্তিক হারে দাম নির্ধারণের জন্য কাজ করছে। তাদের সুপারিশ পাওয়ার পর সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে।
একজন মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব শুনেছি। তবে দাম বাড়ানোর আগে তা ভোক্তাদের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ভবিষ্যতে দাম কেমন থাকবে—এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।”
আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব
বিশ্ববাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বাড়ছে মূলত উৎপাদনকারী দেশগুলোর রপ্তানি সীমিত হওয়ায়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে আবহাওয়ার প্রভাব এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ কমে গেছে। এর ফলে আমদানিনির্ভর দেশ বাংলাদেশে প্রভাব পড়ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল না হলে আগামী কয়েক মাসেও ভোজ্যতেলের দাম কমার সম্ভাবনা নেই।
বিশেষজ্ঞ মতামত
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির ফলে মুদ্রাস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে। তারা পরামর্শ দিচ্ছেন, সরকারকে দ্রুত বিকল্প কৌশল নিতে হবে, যেমন ভর্তুকি দেওয়া বা স্বল্পমূল্যে তেল সরবরাহের ব্যবস্থা করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, “তেলের দাম বাড়লে তা শুধু রান্নাঘরের খরচ বাড়াবে না, বরং রেস্টুরেন্ট, হোটেল ও খাদ্যশিল্পেও খরচ বাড়াবে। এতে সামগ্রিকভাবে মুদ্রাস্ফীতি ত্বরান্বিত হতে পারে।”
ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তবে প্রস্তাবিত দাম বাড়লে তা সাধারণ মানুষের জীবনে বড় চাপ সৃষ্টি করবে। সরকার, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের স্বার্থ সমন্বয় করে একটি টেকসই সমাধান বের করতে পারলেই বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে। এখন দেখার বিষয়, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে কোন দিক প্রাধান্য পায়—ব্যবসায়ীদের খরচ সামলানো নাকি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খরচের চাপ কমানো।
এম আর এম – ১৪৬২,Signalbd.com