বিশ্ব

লেবাননে ইসরাইলি হামলায় ৪ মার্কিন নাগরিক নিহত

Advertisement

লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বিনতে জবেইল আবারও রক্তাক্ত হলো ইসরাইলি বাহিনীর হামলায়। সর্বশেষ ড্রোন হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন আমেরিকার নাগরিক এক বাবা ও তাঁর তিন শিশু সন্তান। নিহত শিশুদের নাম—সেলিন, হাদি ও আসিল। তাঁদের মা গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫) স্থানীয় সময় বিকেলে। লেবাননের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এনএনএ জানায়, ড্রোন হামলায় একটি মোটরসাইকেল ও একটি বেসামরিক গাড়ি লক্ষ্যবস্তু করা হয়। ফলে সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায় এবং ঘটনাস্থলেই নিহত হন পাঁচজন।

পার্লামেন্ট স্পিকারের প্রতিক্রিয়া

লেবাননের পার্লামেন্ট স্পিকার নাবিহ বেরি এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, নিহত চারজনই মার্কিন নাগরিক ছিলেন এবং তারা লেবাননে বসবাস করতেন। বেরি আরও বলেন, “শিশু হত্যার মাধ্যমে ইসরাইল আবারও প্রমাণ করলো তারা মানবিকতা মানে না। এই হামলা যুদ্ধাপরাধের শামিল।”

আহতদের অবস্থা

লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এ হামলায় আরও দুইজন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে শিশুদের মা রয়েছেন, যিনি গুরুতর জখম হলেও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তিনি আশঙ্কামুক্ত।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার পরপরই বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে।

  • কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা প্রথম খবরটি প্রকাশ করে।
  • মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ইসরাইলের ড্রোন হামলায় বারবার শিশু ও সাধারণ মানুষ নিহত হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
  • জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান

নিহতরা মার্কিন নাগরিক হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিক্রিয়া বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (স্টেট ডিপার্টমেন্ট) জানিয়েছে, তারা বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং লেবানন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। তবে এখন পর্যন্ত ইসরাইলের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অভিযোগ আনেনি যুক্তরাষ্ট্র।

বহু বিশ্লেষক বলছেন, আমেরিকার দ্বিমুখী অবস্থান স্পষ্ট। একদিকে তারা তাদের নাগরিক হারাচ্ছে, অন্যদিকে ইসরাইলকে অস্ত্র ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

লেবানন-ইসরাইল সীমান্ত উত্তেজনা

লেবাননের দক্ষিণ সীমান্ত দীর্ঘদিন ধরেই সংঘাতপূর্ণ। বিশেষ করে ফিলিস্তিনে গাজায় চলমান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইল সীমান্তবর্তী এলাকায় হামলা বাড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই লেবাননের হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের সঙ্গে ইসরাইলি বাহিনীর সংঘর্ষের খবর আসছে।

  • গত কয়েক মাসে ইসরাইলের হামলায় শতাধিক লেবাননি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
  • শুধু শিশু ও নারী নিহত হয়েছেন প্রায় ৪০ জনের মতো।
  • জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী (ইউএনআইএফআইএল) সীমান্তে টহল জোরদার করেছে, তবে তা কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

লেবানন ও ইসরাইলের মধ্যে সংঘাত নতুন নয়।

  • ২০০৬ সালে বড় ধরনের যুদ্ধে প্রায় ১,২০০ লেবাননি নিহত হয়েছিলেন, যাদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ।
  • সেই যুদ্ধের পর থেকে এখনো ছোট-বড় হামলা অব্যাহত আছে।
  • বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরাইল বর্তমানে গাজা ও লেবাননে একযোগে হামলা চালিয়ে তাদের সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন করছে।

আন্তর্জাতিক আইন ও যুদ্ধাপরাধ প্রশ্ন

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসামরিক মানুষের ওপর ড্রোন হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও জেনেভা কনভেনশনের পরিপন্থী। শিশুদের লক্ষ্য করে বা তাদের হত্যা করে কোনো রাষ্ট্র নিজেকে বৈধ দাবি করতে পারে না।

স্থানীয় মানুষের প্রতিক্রিয়া

বিনতে জবেইলের বাসিন্দারা জানান, হামলার শব্দে পুরো শহর কেঁপে ওঠে। নিহত পরিবারটি স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিল এবং তারা বহু বছর ধরে লেবাননে বসবাস করছিলেন। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “শিশুদের মরদেহ দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেছি। এটি কোনো সামরিক লক্ষ্য ছিল না, সম্পূর্ণভাবে বেসামরিক পরিবার।”

সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ হামলার পর লেবাননে আরও বড় আকারের সংঘর্ষ শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হিজবুল্লাহ ইতোমধ্যেই ইসরাইলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, শিশু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

মানবিক সংকট

ইতোমধ্যেই লেবাননে খাদ্য, জ্বালানি ও চিকিৎসা সামগ্রী সংকট দেখা দিয়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মানুষ সীমান্ত এলাকা ছেড়ে রাজধানী বৈরুত বা উত্তরাঞ্চলের শহরে পালিয়ে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোও হামলার কারণে কার্যক্রম সীমিত করেছে।

সাংবাদিকদের রিপোর্ট

আল-জাজিরা, বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স ও এএফপি-সহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এই হামলার খবর প্রকাশ করেছে। বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমই বলছে, ইসরাইলের এই পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করবে এবং আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াবে।

লেবাননে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় একই পরিবারের চার মার্কিন নাগরিকসহ পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনা শুধু একটি সংবাদ নয়, এটি মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতের এক ভয়াবহ চিত্র। নিরীহ শিশুদের মৃত্যু বিশ্ব মানবতাবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি সত্যিই কার্যকর ভূমিকা নেবে, নাকি এ ধরনের হামলার শিকার হতে থাকবে সাধারণ মানুষ?

MAH – 12953 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button