জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে অংশ নেবেন তিনি
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন। রবিবার দিবাগত রাত ১টা ৪০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি নিয়মিত ফ্লাইটে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পথে রওনা হন।
ড. ইউনূসের এই সফর শুধু কূটনৈতিক দিক থেকে নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। জাতিসংঘের এই বৈশ্বিক আসরে বাংলাদেশসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের নানা ইস্যু নিয়ে তার বক্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সফরসঙ্গী প্রতিনিধিদল
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সরকারি সফরসঙ্গী হিসেবে যাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাঁচ নেতা। তাঁরা হলেন:
- বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির
- জামায়াতে ইসলামী নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের
- জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন
- এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি প্রতিনিধিদলে যোগ দেবেন জামায়াত নেতা মোহাম্মদ নকিবুর রহমান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফরে বহুদলীয় প্রতিনিধিদল থাকা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ঐক্যের একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করবে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (UNGA) ৮০তম অধিবেশন
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ (UNGA) হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মঞ্চ। প্রতি বছর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর শীর্ষ নেতারা এখানে একত্রিত হয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকারসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
২০২৫ সালের এই ৮০তম অধিবেশনের মূল আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে:
- জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs)
- বৈশ্বিক দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য
- চলমান যুদ্ধ ও সংঘাত (বিশেষ করে ইউক্রেন সংকট, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা)
- খাদ্য নিরাপত্তা ও জ্বালানি সংকট
- শরণার্থী ও অভিবাসন ইস্যু
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার
ড. ইউনূস এসব ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরবেন। বিশেষ করে তিনি দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখবেন বলে কূটনৈতিক মহলে ধারণা করা হচ্ছে।
২৬ সেপ্টেম্বরের ভাষণ
প্রধান উপদেষ্টা ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আনুষ্ঠানিক ভাষণ দেবেন। এটি হবে তার দায়িত্ব নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথম বড় বক্তব্য। তিনি তার ভাষণে বাংলাদেশকে একটি শান্তিপ্রিয়, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরবেন বলে জানা গেছে।
এছাড়া, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবেলায় ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য ন্যায্য সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সমতা, নারী ক্ষমতায়ন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে পারেন তিনি।
সফরের তাৎপর্য
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুধু বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা নন, তিনি নোবেল বিজয়ী বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদও। তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের কূটনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।
অনেকে বলছেন, এ সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, বহুদলীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে এই সফরে যাওয়া দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির এক নতুন বার্তা বিশ্বকে জানাবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক অবদান
ড. ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের জনক হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের তার মডেল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুসরণ করা হচ্ছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাকে উন্নয়ন কৌশলের অগ্রদূত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
তার জীবনের বিভিন্ন সময়ের কাজের মধ্যে রয়েছে:
- গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা (১৯৮৩): দরিদ্র মানুষের কাছে সহজ শর্তে ঋণ পৌঁছে দেওয়া।
- নোবেল শান্তি পুরস্কার জয় (২০০৬): দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণের অসাধারণ অবদানের জন্য।
- বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নেতৃত্ব: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের পক্ষে বক্তব্য প্রদান।
- সামাজিক ব্যবসার ধারণা প্রচলন: যেখানে মুনাফার পরিবর্তে মানুষের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
এই অভিজ্ঞতাই তাকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আরও দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার শক্তি দেবে।
কূটনৈতিক সাক্ষাৎ ও বৈঠক
প্রধান উপদেষ্টা নিউইয়র্কে অবস্থানকালে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে।
প্রত্যাশিত বৈঠকগুলো হতে পারে:
- জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠক
- মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা
- ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ক বৈঠক
- উন্নয়ন সংস্থা ও দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক, যেখানে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গ আসতে পারে
দেশে ফেরার সম্ভাব্য তারিখ
প্রধান উপদেষ্টা তার সফর শেষে আগামী ২ অক্টোবর দেশে ফেরার কথা রয়েছে। তখন তিনি সফরের ফলাফল নিয়ে জাতিকে অবহিত করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা
জনগণের কাছে এ সফরকে ঘিরে কয়েকটি বড় প্রত্যাশা রয়েছে:
- বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি
- জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিপূরণের দাবি জোরালো করা
- অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বৈদেশিক বিনিয়োগে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া
- গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ঐক্যের বার্তা বিশ্বকে জানানো
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই সফর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। জাতিসংঘের মঞ্চে তার কণ্ঠস্বর শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং বিশ্বের প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পক্ষেও শক্তিশালী দাবি হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ পর্যন্ত সবাই তার এই সফরকে ঘিরে আশাবাদী।
তিনি যদি বাংলাদেশের স্বার্থকে শক্তভাবে তুলে ধরতে পারেন, তবে আন্তর্জাতিক মহলে দেশের কূটনৈতিক অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে।
MAH – 12940 I Signalbd.com



