প্রযুক্তি

ইন্টারনেটে কত ডেটা আছে, প্রতিদিন কত যোগ হচ্ছে

Advertisement

আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় আবিষ্কারগুলোর মধ্যে ইন্টারনেট অন্যতম। এক সময় মানুষকে তথ্য পেতে লাইব্রেরিতে দিন কাটাতে হতো, বই ঘাঁটতে হতো, কিংবা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতো। কিন্তু ইন্টারনেট আবিষ্কারের পর সেই চিত্র সম্পূর্ণ বদলে যায়। এখন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের তথ্য কয়েক সেকেন্ডেই পাওয়া যায় হাতের মুঠোয়।

তবে প্রশ্ন হলো—ইন্টারনেটে আসলে কত তথ্য রয়েছে? প্রতিদিন কত নতুন তথ্য যোগ হচ্ছে? বিষয়টি আমাদের কাছে রহস্যময় মনে হলেও, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও গবেষণার মাধ্যমে এর উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন।

ইন্টারনেটের প্রকৃত আকার কত বড়?

২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছিল প্রায় ১৪৯ জেটাবাইট (ZB) ডেটা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা পৌঁছে যাবে প্রায় ১৮১ জেটাবাইটে। তবে কিছু গবেষক বলছেন, হয়তো সংখ্যা একটু কম হবে, প্রায় ১৭৫ জেটাবাইট

এক জেটাবাইট মানে কী?
এক জেটাবাইট সমান এক ট্রিলিয়ন (১,০০০,০০০,০০০,০০০) গিগাবাইট! এত বড় একটি পরিমাণ কল্পনা করাও সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—

  • যদি ১ জেটাবাইট তথ্য ডিভিডিতে রাখা হয়, তবে তা একটার পর একটা সাজালে পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত কয়েকবার পৌঁছানো যাবে।

অর্থাৎ ইন্টারনেটের আকার মাপা মানে যেন সমুদ্রকে একটি ছোট বালতিতে ভরে রাখার চেষ্টা।

প্রতিদিন কত ডেটা তৈরি হচ্ছে?

বিভিন্ন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে ৪০২ মিলিয়ন টেরাবাইট ডেটা তৈরি হয়। বছরে এই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৪৭ জেটাবাইট

এই বিপুল ডেটার উৎস হলো—

  • সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, ছবি ও ভিডিও
  • ইমেইল ও মেসেজ
  • স্মার্টফোন, স্মার্ট ঘড়ি, স্মার্ট টিভি ইত্যাদি ডিভাইস
  • কানেক্টেড গাড়ি ও IoT প্রযুক্তি
  • অনলাইন কেনাকাটা ও ব্যাংকিং ট্রানজ্যাকশন
  • ক্লাউড সার্ভিস
  • বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরীক্ষামূলক ডেটা

প্রতিটি মুহূর্তে কোটি কোটি ব্যবহারকারী তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে নতুন ডেটা যোগ করছেন।

ডিপ ওয়েব ও ডার্ক ওয়েব – অদৃশ্য তথ্যের ভান্ডার

আমরা গুগল, বিং, ইয়াহু বা অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে যে তথ্য পাই, তা মূলত সারফেস ওয়েব। কিন্তু এর বাইরেও আছে বিশাল এক দুনিয়া—ডিপ ওয়েব (Deep Web)

ডিপ ওয়েবে রয়েছে—

  • প্রাইভেট ডেটাবেজ
  • সরকারি নথি
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার
  • হাসপাতালের মেডিকেল রিপোর্ট
  • নিরাপদ অ্যাপ্লিকেশনের ডেটা

এসব তথ্য সার্চ ইঞ্জিনে পাওয়া যায় না। গবেষকরা অনুমান করেন, ডিপ ওয়েবের আকার সারফেস ওয়েবের চেয়ে কয়েকশ’ গুণ বেশি।

এর ভেতরে একটি অংশ হলো ডার্ক ওয়েব, যেখানে গোপন কার্যক্রম চলে, যেমন: হ্যাকিং, অবৈধ লেনদেন ইত্যাদি।

বিশ্বের বৃহত্তম ডেটা উৎপাদক প্রতিষ্ঠান

অনেকে মনে করেন শুধুই সোশ্যাল মিডিয়া সবচেয়ে বেশি ডেটা তৈরি করে। কিন্তু বাস্তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার, সরকারি প্রকল্প ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও বিশাল ডেটা তৈরি করছে।

উদাহরণস্বরূপ—
সার্ন (CERN): ইউরোপের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রের “লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (LHC)” প্রতিদিন তৈরি করে পেটাবাইট পরিমাণ ডেটা। এই ডেটা বিশ্লেষণ করতে হয় সুপারকম্পিউটার ব্যবহার করে।

ডেটা সেন্টারের খরচ ও প্রভাব

এই বিপুল তথ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রয়োজন ডেটা সেন্টার। বিশ্বজুড়ে এখন লক্ষাধিক ডেটা সেন্টার রয়েছে।

  • বর্তমানে বিশ্বের মোট বিদ্যুতের প্রায় ২ শতাংশ ব্যবহার করছে কেবল ডেটা সেন্টার।
  • বড় ডেটা সেন্টারগুলো ঠান্ডা রাখার জন্য প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ গ্যালন পানি খরচ করে।
  • আমাজন, গুগল, মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখন টেকসই শক্তি ও পুনর্ব্যবহৃত পানি ব্যবহার শুরু করেছে।

কিন্তু ডেটা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই খরচ আরও বাড়বে। পরিবেশবিদরা এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন, কারণ এর ফলে বিদ্যুৎ সংকট ও পানির ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

ডেটার ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব

ইন্টারনেটে তৈরি হওয়া ডেটা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে।

ইতিবাচক দিক

  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) উন্নয়ন
  • অনলাইন কেনাকাটায় ব্যক্তিগতকৃত প্রস্তাব
  • মেডিকেল রিসার্চে দ্রুত ফলাফল
  • জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
  • শিক্ষা ও গবেষণায় বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা

নেতিবাচক দিক

  • ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস ও ডেটা প্রাইভেসি হুমকি
  • বিদ্যুৎ ও পানির অপচয়
  • ইন্টারনেট অবকাঠামোর ওপর চাপ
  • ডার্ক ওয়েবের অপরাধমূলক ব্যবহার

ভবিষ্যৎ কোথায় যাচ্ছে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দশকে ডেটার পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বাড়বে। এর বড় অংশ আসবে—

  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
  • মেটাভার্স ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি
  • 5G ও ভবিষ্যতের 6G প্রযুক্তি
  • স্মার্ট সিটি ও IoT ডিভাইস

তবে এই বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ডেটা নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ খরচ ও পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।

ইন্টারনেটে ডেটার পরিমাণ এত বিশাল যে তা কল্পনারও বাইরে। প্রতিদিন কোটি কোটি নতুন তথ্য তৈরি হচ্ছে, যা একদিকে প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে তৈরি করছে নতুন ঝুঁকি।

সুতরাং বলা যায়, ডেটাই হচ্ছে নতুন যুগের তেল। যে দেশ বা প্রতিষ্ঠান ডেটা নিয়ন্ত্রণ করবে, তারাই ভবিষ্যতে প্রযুক্তি ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

MAH – 12936 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button