
বাংলাদেশের স্কুলের শিক্ষার্থীরা আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম দিন থেকেই হাতে পাবে নতুন পাঠ্যপুস্তক। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে বই ছাপানোর প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই বই মুদ্রণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকাশকদের তালিকা ঘোষণা করা হবে।
রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সকালে সচিবালয়ে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ তথ্য জানান।
অনিয়মের অভিযোগ থাকলে সুযোগ নেই
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “গত বছর বই ছাপানোর ক্ষেত্রে কিছু অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। এ বছর যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এসেছে, তাদের কাজ আর দেওয়া হবে না। আমরা চাই শিক্ষার্থীরা নির্ভুল ও মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক হাতে পাক। তাই এবার মুদ্রণ ও বিতরণ প্রক্রিয়া হবে আরও স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য।”
এছাড়া তিনি আরও জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যাশনাল কারিকুলাম অ্যান্ড টেক্সটবুক বোর্ড (এনসিটিবি) ইতোমধ্যেই প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের প্রুফ সম্পাদনা সম্পন্ন করেছে। এখন শুধু দ্রুতগতিতে মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের কাজ শুরু হবে।
জানুয়ারির ১ তারিখেই বই উৎসব
বাংলাদেশে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে ১ জানুয়ারি ‘বই উৎসব’ এর মাধ্যমে বিনামূল্যে বই তুলে দেওয়া হয়। এটি বিশ্বের মধ্যে একটি অনন্য উদ্যোগ। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ কর্মসূচি শিক্ষার প্রসার ও বিদ্যালয়ে ভর্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। এর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের জন্য প্রায় ১২ কোটি এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য ২৩ কোটি বই ছাপানো হবে।
পূর্বের অভিজ্ঞতা ও অনিয়ম
গত বছর বই মুদ্রণ ও সরবরাহে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল যে, কিছু বইয়ে মুদ্রণ ভুল, বানান সমস্যা ও ছবির অসামঞ্জস্য ছিল। এমনকি কিছু বই নির্ধারিত সময়ের পরে পৌঁছেছিল গ্রামাঞ্চলের স্কুলে। এ বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও সমালোচিত হয়।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা এ বছর কোনো ধরনের অনিয়ম বা দেরি বরদাশত করব না। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনে বছরের শুরুতে বই হাতে পাওয়া একটি বড় আনন্দ, এটি যেন ব্যাহত না হয় সেটি নিশ্চিত করা হবে।”
বই বিতরণের গুরুত্ব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। একদিকে এটি অভিভাবকদের আর্থিক চাপ কমিয়েছে, অন্যদিকে শিশুদের শিক্ষায় আগ্রহ বাড়িয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক) এ বিষয়ে বলেন, “বছরের শুরুতেই বই হাতে পাওয়া মানে শিশুর মনে পড়াশোনার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হওয়া। শিক্ষার প্রতি সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। তবে মানের দিকে আরও কড়াকড়ি হওয়া প্রয়োজন।”
টিকা কেনা ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা
একই বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা টিকা কেনা সম্পর্কেও তথ্য দেন। তিনি বলেন, “সরকার ইতোমধ্যেই টিকা আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। ইউনিসেফের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন কমানোর চেষ্টা চলছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে নতুন টিকা আনা হবে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এই দুই খাতেই সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বই বিতরণের ইতিহাস
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার প্রথমবার বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের উদ্যোগ নেয়। তখন থেকে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হচ্ছে।
শুরুতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বই বিতরণ করা হলেও পরে মাদ্রাসা ও প্রযুক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্যও এ সুবিধা চালু করা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কোটিরও বেশি পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে গেছে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
তবে বই ছাপানো ও বিতরণ একটি বিশাল কাজ। এজন্য সরকারকে প্রচুর ব্যয় করতে হয়। অর্থনৈতিক মন্দা, কাগজের মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রণ ব্যয় বৃদ্ধি এবং পরিবহন সংকটের কারণে প্রতিবারই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার যদি সঠিকভাবে বাজেট ব্যবস্থাপনা করে এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করে তবে এ প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হবে।
এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আমরা চাই বই বিতরণ কার্যক্রম আরও আধুনিক হোক। ভবিষ্যতে ডিজিটাল পাঠ্যপুস্তকের দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনলাইনে ফ্রি পিডিএফ বই আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছে, তবে আমরা চাই শিক্ষার্থীরা হাতে ছাপা বইও পাবে।”
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর প্রতিক্রিয়া
ঢাকার মিরপুরের এক অভিভাবক রুবিনা আক্তার বলেন, “প্রতি বছর জানুয়ারির ১ তারিখে আমার ছেলে নতুন বই পায়। ওর আনন্দ দেখে আমি খুব খুশি হই। আশা করি এ বছরও সময়মতো বই আসবে।”
গাইবান্ধার এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাফিজুর রহমান বলেন, “গ্রামে বই পৌঁছাতে কখনো কখনো দেরি হয়। তবে সরকার যদি সময়মতো ব্যবস্থা নেয় তাহলে শিক্ষার্থীরা আরও উৎসাহিত হবে।”
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
বাংলাদেশের এই বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো একে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ‘রোল মডেল’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
জানুয়ারির প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার ঘোষণা নিঃসন্দেহে শিক্ষাক্ষেত্রে আশার আলো জাগিয়েছে। অনিয়ম ঠেকাতে সরকারের উদ্যোগ, স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দেওয়া—সবকিছু মিলিয়ে এটি শুধু শিক্ষার মানোন্নয়নই নয়, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত করার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
MAH – 12920 I Signalbd.com