শিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার ১৪ ভেড়া চুরি, ভারাক্রান্ত গবেষক

Advertisement

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) চলমান গবেষণা প্রকল্প থেকে ১৪টি উন্নত জাতের ভেড়া চুরি হয়ে গেছে। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার ভোরের মধ্যে মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ সংলগ্ন খামারে তালা ভেঙে এ ঘটনা ঘটে। এই ভেড়াগুলো ছিল ‘দরপার’ ও ‘গাড়ল’ জাতের, যেগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চলছিল। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসতেই বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে নেমে আসে হতাশা আর ক্ষোভ।

ঘটনাস্থলের চিত্র ও নিরাপত্তার দুর্বলতা

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ওই রাতে খামারে কোনো প্রহরী দায়িত্বে ছিলেন না। সন্ধ্যার পরই নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব ছেড়ে চলে যান। সকালে এসে দেখা যায় খামারের প্রধান দরজার তালা ভাঙা এবং ১৪টি ভেড়া উধাও। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কাউন্সিল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের কাজ শুরু করেছে। তবে এখন পর্যন্ত চোর বা সংশ্লিষ্ট কারও পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. নাজমুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাতের শিফটে কর্মী না থাকার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। ইতিমধ্যে পুলিশকে জানানো হয়েছে এবং দ্রুত ভেড়াগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

গবেষণায় ভেড়ার গুরুত্ব

চুরি যাওয়া ভেড়াগুলো নিয়ে গবেষণা করছিলেন সার্জারি ও অবস্টেট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদা ইয়াসমিন বারি। তিনি বলেন, “এটি শুধু একটি প্রাণীচুরি নয়, এটি গবেষণার ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই ভেড়াগুলো দিয়ে আমরা প্রজনন প্রকল্প এবং এমব্রায়ো ট্রান্সফার প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিলাম। আমার সারা জীবনের সাধনার ফল এক রাতে মুছে গেল।”

ভেড়াগুলো থেকে সংগ্রহ করা হতো সিমেন ও ভ্রূণ, যা ব্যবহার করতেন স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি শিক্ষার্থীরা। ফলে এই চুরির কারণে শুধু গবেষণাই নয়, শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।

দীর্ঘ গবেষণা ও স্বীকৃতি

ড. ফরিদা ইয়াসমিন ২০১১ সাল থেকে ভেড়া নিয়ে কাজ করছেন। মাল্টিপল ওভুলেশন এবং এমব্রায়ো ট্রান্সফার নিয়ে তাঁর গবেষণা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয় এবং এজন্য তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস (বিএএস) গোল্ড মেডেল অর্জন করেছিলেন। দেশে প্রথমবারের মতো ভেড়ার ভ্রূণ স্থানান্তর প্রযুক্তি চালু করে তিনি সফলভাবে বাচ্চা উৎপাদন করেছিলেন।

এই প্রকল্প থেকে বছরে ২৫–৩০টি উন্নত প্রজাতির ভেড়ার ভ্রূণ উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছিল। যা একদিকে প্রোটিন ঘাটতি পূরণে ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করছে। ফলে এই চুরি শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং জাতীয় ক্ষতির কারণ।

প্রভাবিত শিক্ষার্থীরা

চুরির ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও হতাশ। চতুর্থ বর্ষ থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থীর গবেষণা এই ভেড়াগুলোর ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন তাদের গবেষণা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। একজন শিক্ষার্থী বলেন, “আমাদের গবেষণা ডেটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এখন আবার শুরুর মতো অবস্থা। এটা শুধু আমাদের সময় নষ্ট করবে না, অনেকের ক্যারিয়ারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

অতীতেও ক্ষতি হয়েছে

এটি প্রথম নয়, এর আগে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রায় ২২টি গবেষণারত ভেড়া মারা গিয়েছিল। এরপর আবারও একই ধরনের বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ল প্রকল্পটি। ফলে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—গবেষণার মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের নিরাপত্তা কেন যথাযথভাবে নিশ্চিত করা হলো না?

প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কাউন্সিলের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, “ঘটনার তদন্ত চলছে। সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে। চুরির সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হবে।”

গবেষক ও শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা

গবেষকরা বলছেন, ভেড়াগুলো উদ্ধারের পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা গবেষণার ফল এভাবে নষ্ট না হয়।

একজন শিক্ষার্থী বলেন, “ভেড়াগুলো ফিরে আসুক বা না আসুক, আমরা চাই অন্তত এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটুক। আমাদের গবেষণা যেন নিরাপদ থাকে।”

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪টি গবেষণারত ভেড়া চুরির ঘটনাটি শুধু একটি প্রাণী হারানোর বিষয় নয়; এটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ও দেশের কৃষি উন্নয়নের ওপর এক বিশাল আঘাত। প্রশাসন তদন্তে নেমেছে, তবে ভেড়াগুলো উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত গবেষক ও শিক্ষার্থীদের কষ্ট ও ক্ষোভ কাটছে না। এখন প্রশ্ন হলো—গবেষণার নিরাপত্তা কতটা অগ্রাধিকার পাবে?

এম আর এম – ১৪২৬,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button