
আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে হালকা প্রকৌশল (Light Engineering) যন্ত্রপাতি রপ্তানি ১,২০০ কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে। বর্তমানে এই খাত থেকে বছরে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কোটি ডলার রপ্তানি হয়। এ তথ্য উদঘাটন করা হয়েছে ‘রোড টু মেড ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড অ্যাগ্রো মেশিনারি ফেয়ার ২০২৫’ অনুষ্ঠানে, যা শনিবার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় এডিসন প্রাইম ভবনে অনুষ্ঠিত হয়।
এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ। তারা উভয়েই হালকা প্রকৌশল, অটোমোবাইল এবং কৃষি যন্ত্রাংশ খাতকে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরেন।
হালকা প্রকৌশল খাতের বিশাল সম্ভাবনা
এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ৮০,০০০ মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি হালকা প্রকৌশল ইউনিট রয়েছে। দেশের স্থানীয় বাজারের আকার প্রায় ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলার। খাতটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ২৮ শতাংশ, যা বাংলাদেশের শিল্প ও রপ্তানি সক্ষমতার জন্য এক বিশাল সুযোগ।
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে কৃষি যন্ত্রের মাত্র ২০ শতাংশই দেশীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, বাকি ৮০ শতাংশই আমদানি-নির্ভর। সঠিক নীতি, প্রযুক্তি ও দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে এই ২০ শতাংশ অচিরেই ৪০ থেকে ৬০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব।”
কৃষি যন্ত্রপাতি ও খাদ্য নিরাপত্তা
বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনে যান্ত্রিকীকরণের অভাবের কারণে ফসলের প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ নষ্ট হয়। বিশেষ করে ফল, শাকসবজি ও তাজা খাদ্যে অপচয় বেশি। এম মাসরুর রিয়াজ উল্লেখ করেন, কৃষি যন্ত্রপাতি ও লজিস্টিক অবকাঠামো উন্নয়ন না হলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও রপ্তানির সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব নয়।
“কৃষি খাতের আধুনিকায়ন ও স্থানীয় যন্ত্রপাতির উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা খাদ্য অপচয় কমিয়ে রপ্তানি বাড়াতে পারব। এটি শুধু কৃষকের উপার্জন বাড়াবে না, দেশের অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করবে,” তিনি বলেন।
‘রোড টু মেড ইন বাংলাদেশ’ ফেয়ার ২০২৫
ফেয়ারটি দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে ২৬টি স্টলে প্রদর্শিত হয়েছে অটোমোবাইল, কৃষি যন্ত্রপাতি ও হালকা প্রকৌশল খাতের উৎপাদন। এছাড়াও শিল্পসহায়ক প্রতিষ্ঠান ১২টি স্টলে অংশগ্রহণ করেছে। প্রদর্শনীতে বাংলাদেশ অটোমোবাইলস অ্যাসেম্বলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ও এগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ সহযোগিতা করেছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিসিআই-এর সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে। কৃষি, প্রবাসী আয় ও গার্মেন্টস খাত অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হলেও নতুন কর্মসংস্থান ও টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য হালকা প্রকৌশল শিল্পে গুরুত্ব দিতে হবে।”
শিল্পনীতির অগ্রাধিকার
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান বলেন, “জাতীয় শিল্পনীতিতে অটোমোবাইল, কৃষি যন্ত্রাংশ ও হালকা প্রকৌশলকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই খাতগুলো উৎপাদনশীল শিল্পের বিকাশ, রপ্তানির বহুমুখীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও আঞ্চলিক উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা শিল্পনীতির মূল লক্ষ্য।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “কৃষি ও অটোমোবাইলস খাতের মেলাগুলি দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে। নতুন ব্যবসায়িক সম্ভাবনা তৈরি হবে এবং স্থানীয় উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব হবে।”
হালকা প্রকৌশল রপ্তানিতে বাংলাদেশের সুযোগ
হালকা প্রকৌশল খাত থেকে রপ্তানি বৃদ্ধি একটি বড় সম্ভাবনা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ এই খাতে বছরে ৭০ থেকে ৮০ কোটি ডলার রপ্তানি করে। তবে সঠিক নীতি, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও দক্ষ জনশক্তি থাকলে আগামী ৫ থেকে ৭ বছরে এটি ১,২০০ কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে।
বাংলাদেশে প্রায় ৮০,০০০ মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ইউনিট হালকা প্রকৌশল শিল্পে কাজ করছে। স্থানীয় বাজারের আকার প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। খাতটির বার্ষিক বৃদ্ধির হার প্রায় ২৮ শতাংশ।
অটোমোবাইল খাতের শিক্ষণীয় উদাহরণ
আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, “অটোমোবাইল খাতের উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, স্থানীয় উৎপাদন বাড়ালে আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব। একই কৌশল হালকা প্রকৌশল ও কৃষি যন্ত্রপাতি খাতে প্রয়োগ করলে রপ্তানি বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি সহজ হবে।”
আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ
বিশ্বে এগ্রিকালচার মেশিনারি খাতের বাজার প্রায় ১.৯৭ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি ডলার। বাংলাদেশ এখনো সেই বাজারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারেনি। স্থানীয় বাজারের সম্ভাবনা প্রায় ১২ বিলিয়ন বা ১,২০০ কোটি ডলার। কিন্তু এর অর্ধেকও ব্যবহার করা যায়নি। সঠিক পরিকল্পনা ও নীতি থাকলে দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ওবায়দুর রহমান, র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক এম আবু ইউসুফ এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। তারা শিল্পের আধুনিকায়ন, নীতি সহায়তা, কর ছাড় ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে হালকা প্রকৌশল, কৃষি যন্ত্রপাতি ও অটোমোবাইল খাত নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দরজা খুলছে। সঠিক নীতি, আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ মানবসম্পদ থাকলে আগামী ৫ থেকে ৭ বছরে রপ্তানি আয় ১,২০০ কোটি ডলারে উন্নীত হওয়া সম্ভব। এটি কেবল দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করবে না, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় করবে।
MAH – 12917 I Signalbd.com