আঞ্চলিক

তক্ষীরায় বিদ্যুৎ বিপর্যয়: গ্রিডে আগুন, আতঙ্কে হাজারো মানুষ

Advertisement

সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় অবস্থিত পাওয়ার গ্রিডের একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্সফরমারে হঠাৎ করেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় পুরো সাতক্ষীরা জেলাজুড়ে প্রায় দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫) বেলা ১১টার কিছু পরেই এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় বলে জানা গেছে।

ফায়ার সার্ভিস দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রায় ২০ মিনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে এই অল্প সময়ের ভেতরেই গ্রিডের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়, ফলে গোটা জেলায় বিদ্যুৎহীন অবস্থায় মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছে।

ঘটনাস্থলের বিবরণ

ঘটনাটি ঘটে সাতক্ষীরা শহরের প্রাণকেন্দ্র বিনেরপোতা গ্রিড সাবস্টেশনে। এ স্থানটি জেলার বিদ্যুৎ সরবরাহের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ট্রান্সফরমারে হঠাৎ বিকট শব্দ ও ধোঁয়া দেখা দিলে আশপাশের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই গ্রিডে কাজ করা কর্মীরা সরে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়।

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ করে ট্রান্সফরমারের ভেতর থেকে আগুন বের হতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রিড এলাকার আশপাশে বসবাসরত মানুষজন আতঙ্কে বাইরে বের হয়ে আসে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা

খুলনা গ্রিড থেকে জরুরি ভিত্তিতে সাতক্ষীরার সব ফিডার বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো যায়। এতে পুরো সাতক্ষীরা জেলা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। হাসপাতাল, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা এমনকি গৃহস্থালির সাধারণ মানুষও বিদ্যুৎ না থাকায় ভোগান্তিতে পড়ে।

সাতক্ষীরা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার সনৎ কুমার ঘোষ বলেন,

“পাওয়ার গ্রিডের একটি ট্রান্সফরমারে আগুন লাগে। আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেই। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিদ্যুৎ সংযোগ পুনরায় চালু করা হয়েছে।”

বিদ্যুৎ পুনঃসংযোগ ও স্বস্তি

দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকার পর ধীরে ধীরে পুনঃসংযোগ শুরু হয়। দুপুর ১টার পর থেকেই ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ আসতে থাকে। তবে কিছু এলাকায় এখনও সমস্যার খবর পাওয়া যায়। নির্বাহী প্রকৌশলী সোয়েব হোসেন জানান,

“প্রায় গোটা জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়েছে। কিছু কিছু স্থানে অল্প সময়ের ভেতরেই বিদ্যুৎ ফিরে আসবে।”

আগুন লাগার সম্ভাব্য কারণ

সাতক্ষীরা ফায়ার সার্ভিসের ওয়ারহাউস পরিদর্শক নুরুল ইসলাম জানান,

“প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ট্রান্সফরমার ওভারহিট অথবা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তবে সঠিক কারণ জানার জন্য তদন্ত চলছে।”

বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে অনেক গ্রিড ও ট্রান্সফরমারের সরঞ্জাম পুরনো এবং সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। এর ফলে প্রায়ই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

মানুষের ভোগান্তি

বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় দুপুরের গরমে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও অন্যান্য চিকিৎসাকেন্দ্রে বিদ্যুতের ব্যাকআপ থাকলেও অনেক এলাকায় পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা জানান, হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় বাজারে ক্রেতাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।

একজন দোকানদার বলেন,

“এমনিতেই বিদ্যুৎ চলে গেলে ব্যবসা বন্ধ থাকে। আজকে হঠাৎ করে এত বড় বিপর্যয় হলো যে পুরো শহর থমকে গিয়েছিল।”

অতীতে এ ধরনের দুর্ঘটনা

সাতক্ষীরায় এটাই প্রথম নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে ট্রান্সফরমারে ত্রুটি ও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। শুধু সাতক্ষীরা নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রিড ও সাবস্টেশনে আগুন লাগার একাধিক ঘটনা ঘটেছে।

  • ২০২৩ সালে খুলনার ফুলতলায় গ্রিডে আগুন লাগায় কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল।
  • ২০২৪ সালে ঢাকার আমিনবাজার গ্রিডে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, ফলে রাজধানীর বড় অংশ বিদ্যুৎবিহীন হয়।

এসব ঘটনা প্রমাণ করে, বিদ্যুৎ অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকায়ন জরুরি।

বিদ্যুৎ খাতে চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অথচ অনেক জায়গায় গ্রিড লাইন, সাবস্টেশন ও ট্রান্সফরমার পুরনো। সময়মতো মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যায়।

বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ালেই হবে না, বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন প্রয়োজন। নইলে সাতক্ষীরার মতো দুর্ঘটনা আরও বাড়তে পারে।

সরকার ও বিদ্যুৎ বিভাগের করণীয়

এই ঘটনার পর সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলছে—কেন ট্রান্সফরমার হঠাৎ বিস্ফোরিত হলো? নিয়মিত পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে হয়তো এমন ঘটনা ঘটতো না।

সরকার ও বিদ্যুৎ বিভাগের করণীয় হতে পারে:

  1. নিয়মিত ট্রান্সফরমার পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ।
  2. আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রিড সুরক্ষিত রাখা।
  3. পুরনো যন্ত্রপাতি দ্রুত পরিবর্তন।
  4. জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

সাতক্ষীরার পাওয়ার গ্রিডে এই অগ্নিকাণ্ড আবারও প্রমাণ করেছে, বিদ্যুৎ খাতে অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়ে গেছে। যদিও ফায়ার সার্ভিস ও বিদ্যুৎ বিভাগের দ্রুত পদক্ষেপের কারণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, তবে এ ঘটনা ভবিষ্যতে আরও সতর্ক হওয়ার বার্তা দিচ্ছে।

মানুষের দৈনন্দিন জীবন বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। তাই বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় সামান্য ত্রুটি হলেও পুরো জেলার মানুষ ভোগান্তিতে পড়ে। সাতক্ষীরার এই ঘটনাটি থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতকে আরও শক্তিশালী ও সুরক্ষিত করা জরুরি।

MAH – 12912 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button