
এস্তোনিয়ার আকাশে রুশ যুদ্ধবিমান: ন্যাটোর অভিযোগ
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো অভিযোগ করেছে, এস্তোনিয়ার আকাশসীমায় রাশিয়ার তিনটি মিগ-৩১ যুদ্ধবিমান অনুপ্রবেশ করেছে। ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫)। ন্যাটোর তথ্য অনুযায়ী, অনুমতি ছাড়াই যুদ্ধবিমানগুলো ফিনল্যান্ড উপসাগরের আকাশ পেরিয়ে এস্তোনিয়ায় প্রবেশ করে এবং প্রায় ১২ মিনিট সেখানে অবস্থান করে।
ঘটনার পর ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর ইতালির এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, পাশাপাশি সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের জেট দ্রুত সাড়া দিয়ে রুশ বিমানের সামনে বাধা সৃষ্টি করে। পরে রুশ বিমানগুলো আকাশসীমা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
এস্তোনিয়ার সরকারের প্রতিক্রিয়া
এস্তোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ক্রিসেন মিখাল সাংবাদিকদের বলেন—
“রাশিয়ান যুদ্ধবিমান আমাদের সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করেছে। ন্যাটো ও আমাদের মিত্ররা দ্রুত সাড়া না দিলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। রুশ জেটগুলো পালাতে বাধ্য হয়েছে।”
এস্তোনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, এই ঘটনাকে তারা ‘অগ্রহণযোগ্য’ এবং ‘আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ’ হিসেবে দেখছে। এস্তোনিয়া ন্যাটোর সদস্য হওয়ায়, আকাশসীমা রক্ষায় জোটের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে দেশটি মনে করছে।
ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া
ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটে বলেন—
“আমরা খুব দ্রুত ও কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। আমাদের যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থাই এ ধরনের অনুপ্রবেশের মূল জবাব।”
ন্যাটো সদর দফতরের তথ্যমতে, এস্তোনিয়ায় বর্তমানে ‘ইস্টার্ন সেনট্রি’ অভিযান চালানো হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সদস্য রাষ্ট্রগুলো পালাক্রমে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করছে। এর ফলে এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
রাশিয়ার অস্বীকার
অন্যদিকে, রাশিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, তাদের মিগ-৩১ জেটগুলো কেরেলিয়া থেকে কালিনিনগ্রাদ অঞ্চলে যাওয়ার পথে ছিল। সেগুলো বাল্টিক সাগরের ওপর দিয়ে উড়েছে এবং এস্তোনিয়ার আকাশসীমা থেকে অন্তত তিন কিলোমিটার দূরে ছিল।
রুশ কর্তৃপক্ষের ভাষ্য—
“আমাদের বিমান আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলেছে। আমরা কোনো দেশের সীমান্ত লঙ্ঘন করিনি।”
বাল্টিক অঞ্চলে বাড়ছে উত্তেজনা
এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া—এই তিনটি ছোট দেশই বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর স্বাধীনতা লাভ করেছে। বর্তমানে এরা ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য।
কিন্তু ভূগোলগত কারণে রাশিয়ার প্রভাব বলয় থেকে এরা পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। বিশেষ করে কালিনিনগ্রাদ অঞ্চল, যা রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি অংশ, তা বাল্টিক অঞ্চলে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে।
ন্যাটো মনে করছে, রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবেই বাল্টিক অঞ্চলে সামরিক চাপ সৃষ্টি করছে, যাতে পশ্চিমা দেশগুলো ভীত হয় এবং ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নরম করে।
অতীতের ঘটনা
এটি প্রথম নয়। এর আগে একাধিকবার রাশিয়ান যুদ্ধবিমান বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর আকাশসীমায় প্রবেশের অভিযোগ উঠেছে।
- ২০২৩ সালে, লাটভিয়ার আকাশসীমায় একটি রুশ যুদ্ধবিমান প্রবেশ করেছিল।
- ২০২৪ সালে, ফিনল্যান্ডের আকাশেও একই ধরনের অনুপ্রবেশ ঘটে।
প্রতিবারই রাশিয়া অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনার উদ্দেশ্য হলো ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করা এবং সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তি তৈরি করা।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতামত
আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়ার এসব কর্মকাণ্ডকে ‘মিলিটারি শো-অফ’ বা শক্তি প্রদর্শন হিসেবে দেখা উচিত।
- এস্তোনিয়ার মতো ছোট দেশের জন্য এটি নিরাপত্তার বড় হুমকি।
- ন্যাটোর জন্যও এটি চ্যালেঞ্জ, কারণ বারবার এমন ঘটনা ঘটলে কূটনৈতিক সংকট গভীর হয়।
- ইউক্রেন যুদ্ধে যখন রাশিয়া আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে, তখন এই ধরনের আঞ্চলিক উসকানি দিয়ে তারা মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করতে চায়।
এস্তোনিয়ার কৌশল ও ন্যাটোর ভূমিকা
এস্তোনিয়া বলছে, তারা একা রাশিয়ার মোকাবিলা করতে পারবে না। তাই ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ছাতার নিচে থাকতে হবে। দেশটি ইতোমধ্যে সাইবার সিকিউরিটি, এয়ার ডিফেন্স এবং সামরিক ঘাঁটি উন্নয়নে ন্যাটোর সহযোগিতা চাইছে।
ন্যাটোও বাল্টিক অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি আরও জোরদার করছে। বর্তমানে এখানে ব্রিটিশ, জার্মান, কানাডিয়ান ও আমেরিকান সেনা মোতায়েন রয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব
বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধ সরাসরি বাল্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে।
- রাশিয়া ইউক্রেনে ব্যর্থ হলে, তারা ন্যাটোর সীমান্ত অঞ্চলে চাপ বাড়াতে চাইবে।
- আবার সফল হলে, বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোতে হুমকি আরও তীব্র হবে।
তাই এস্তোনিয়ার ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যাবে না। এটি আসলে ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এস্তোনিয়ার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে।
- ওয়াশিংটন বলেছে, “ন্যাটোর এক ইঞ্চি মাটিও রক্ষার অঙ্গীকার অটল থাকবে।”
- ব্রাসেলস থেকে বলা হয়েছে, “রাশিয়ার এই ধরনের কর্মকাণ্ড শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।”
এস্তোনিয়ার আকাশসীমায় রুশ যুদ্ধবিমান প্রবেশের অভিযোগ শুধু একটি আঞ্চলিক ঘটনা নয়। এটি আসলে ইউরোপের নিরাপত্তা পরিস্থিতির জটিলতা ও ন্যাটো-রাশিয়া ক্ষমতার লড়াইয়ের নতুন অধ্যায়।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। তাই আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও সামরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি সংলাপের পথ খোলা রাখা জরুরি।
MAH – 12911 I Signalbd.comএস্তোনিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন: ন্যাটো-রাশিয়া উত্তেজনা