
সুদানে আবারও রক্তপাত
আফ্রিকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দেশ সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধ নতুন করে ভয়াবহ আঘাত হানল সাধারণ মানুষের উপর। শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫) ফজরের নামাজ চলাকালে দারফুরের এল-ফাশের শহরের একটি মসজিদে ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৭৮ জন মুসল্লি। এ ঘটনায় আরও অন্তত ২০ জন গুরুতর আহত হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নামাজ চলাকালে ড্রোন বিস্ফোরণে মুহূর্তেই ধসে পড়ে মসজিদের ছাদ ও দেয়াল, ঘটনাস্থলেই অধিকাংশ নিহত হন।
এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা লোকদের উদ্ধারে কাজ করছে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল ও আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলো। ফলে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কারা দায়ী এই হামলার জন্য?
ঘটনার পরই অভিযোগের আঙুল উঠেছে সুদানের শক্তিশালী প্যারামিলিটারি বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)-এর দিকে। তবে সংগঠনটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হামলার দায় স্বীকার করেনি। সরকারি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, ড্রোনটি ছিল আধুনিক প্রযুক্তির এবং সেটি সামরিক বাহিনী নয়, বরং বিদ্রোহী আরএসএফ ব্যবহার করেছে।
দারফুর অঞ্চলে প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকারি সেনাদের সঙ্গে আরএসএফের সংঘর্ষ চলছে। এল-ফাশের বর্তমানে সুদানি সেনাবাহিনীর শেষ প্রধান ঘাঁটি। ফলে শহরটি দখল করতে আরএসএফ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
দারফুর: এক রক্তাক্ত ইতিহাস
সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই সহিংসতা ও গৃহযুদ্ধের জন্য পরিচিত।
- ২০০৩ সালে প্রথম বড় আকারে সংঘাত শুরু হয়, যখন স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়।
- এরপর থেকে দারফুরে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে, যেখানে লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
- জাতিসংঘের হিসাবে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে শুধুমাত্র দারফুর সংঘাতের কারণে।
এল-ফাশের শহরটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি দারফুরের রাজধানী এবং আশেপাশের বহু গ্রাম ও জেলার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। তাই এই শহর নিয়ন্ত্রণ মানে গোটা পশ্চিম সুদানের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
ড্রোন যুদ্ধ: সুদানে নতুন মাত্রা
বিশ্লেষকরা বলছেন, সুদানের যুদ্ধ ক্রমেই আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে। আগে যেখানে মূলত স্থলযুদ্ধ হত, এখন সেখানে যুক্ত হচ্ছে ড্রোন ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র।
- ড্রোন হামলার মাধ্যমে বেসামরিক স্থাপনাগুলো টার্গেট করা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেড়েছে।
- শুধু দারফুরেই নয়, রাজধানী খার্তুমেও বেশ কিছু এলাকায় ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে।
- সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, বহিরাগত শক্তিগুলো আরএসএফকে আধুনিক ড্রোন সরবরাহ করছে।
মানবিক বিপর্যয়
এই হামলার পর জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
- জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “উপাসনালয়ে হামলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এটি স্পষ্টতই যুদ্ধাপরাধের শামিল।”
- আন্তর্জাতিক রেড ক্রস জানিয়েছে, স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ওষুধ, রক্ত ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে।
- ইতোমধ্যে প্রতিবেশী চাদ ও দক্ষিণ সুদানে হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে যেতে শুরু করেছে।
সাধারণ মানুষের ভয়াবহ জীবনযাপন
দারফুরের মানুষ আজ প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর আতঙ্কে বসবাস করছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান:
- প্রতিদিন শহরে গোলাগুলি, রকেট বা ড্রোন হামলার শব্দ শোনা যায়।
- বিদ্যুৎ, পানি ও খাবারের তীব্র সংকট চলছে।
- স্কুল ও বাজার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
- শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) অবিলম্বে শান্তি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে।
- যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, “সুদানে নিরীহ নাগরিকদের ওপর এ ধরনের হামলা বন্ধ না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
- আরব লিগও শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে নতুন উদ্যোগ নেবে বলে জানিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছে এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার শান্তি রক্ষায় আন্তর্জাতিক উদ্যোগকে সমর্থন করবে বলে জানিয়েছে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের অংশ হিসেবে বহু বছর ধরে সুদানে বাংলাদেশি সেনারা দায়িত্ব পালন করে আসছে।
শান্তির কোনো সমাধান কি আছে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, সুদানের এই সংঘাত যদি দ্রুত বন্ধ না হয় তবে তা পুরো আফ্রিকা মহাদেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
- একদিকে মানবিক বিপর্যয়,
- অন্যদিকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংকট,
- এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সক্রিয় হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং প্রতিবেশী দেশগুলো যৌথভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালালেও মাঠপর্যায়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
সুদানের মসজিদে ভয়াবহ ড্রোন হামলা শুধু একটি মানবিক বিপর্যয় নয়, এটি গোটা দারফুর সংঘাতের ভয়াবহ চিত্রকে আবারও বিশ্বের সামনে তুলে ধরল। নিরীহ মানুষদের জীবন যেন রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতার লড়াইয়ে তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। এখন একটাই প্রশ্ন—আফ্রিকার এই দেশটি কবে শান্তি পাবে?
MAH – 12899 I Signalbd.com