
চুয়াডাঙ্গা ও আশেপাশের জেলাগুলোতে বৈদ্যুতিক মিটার চুরির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। চোরচক্র এখন নতুন কৌশল নিয়েছে—মিটার চুরি করার পর ঘটনাস্থলেই ঝুলিয়ে যাচ্ছে একটি মোবাইল নম্বর। ওই নম্বরে যোগাযোগ করলে মিটারের “মুক্তিপণ” দাবি করছে চোররা। টাকা পাঠালেই কিছু ক্ষেত্রে ফেরত দেওয়া হচ্ছে মিটার, আবার অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকরা প্রতারিত হচ্ছেন।
মিটার চুরি ও মুক্তিপণ আদায়ের অভিনব কৌশল
গত কয়েক রাতেই চুয়াডাঙ্গার হাতিকাটা, আলুকদিয়া ও ভালাইপুর এলাকায় অন্তত অর্ধশত তিন-ফেজ বৈদ্যুতিক মিটার চুরি গেছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই চুরির পর খুঁটির সঙ্গে বা কাছাকাছি কোথাও একটি কাগজে মোবাইল নম্বর লিখে রেখে যাচ্ছে চোররা।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার (বিকাশ, নগদ বা রকেট) মাধ্যমে টাকা পাঠালে নির্দিষ্ট স্থানে মিটার রেখে যাচ্ছে তারা। তবে সবাই যে ফেরত পাচ্ছেন তা নয়—অনেকে টাকা দিয়ে অপেক্ষায় থেকেও কিছু পাননি।
একজন ভুক্তভোগী বলেন,
“আমার মিটার চুরি হওয়ার পর চোরেরা বিকাশে ৪ হাজার টাকা পাঠাতে বলে। টাকা পাঠানোর কয়েক ঘণ্টা পর তারা জানায়, অমুক জায়গা থেকে মিটার নিয়ে যান। আমি গিয়ে সংগ্রহ করেছি।”
আরেকজন জানান,
“আমার মিটারও চুরি হয়েছে। ফোনে বলল, টাকা পাঠালেই ফেরত দেবে। কিন্তু টাকা পাঠানোর পর থেকে আর কোনো সাড়া নেই।”
স্থানীয়রা বলছেন, একেকটি মিটারের জন্য ৪ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করছে চোরচক্র।
এক রাতেই উধাও ২৩টি মিটার
চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকায় এক রাতেই একসঙ্গে ২০-২৫টি মিটার চুরির ঘটনাও ঘটেছে। এতে আতঙ্ক ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে এলাকাজুড়ে।
একজন বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“চোরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। শুধু আমার এলাকায় এক রাতেই ২৩টা মিটার চুরি গেছে।”
আরেকজন অভিযোগ করে বলেন,
“বিদ্যুৎ বিভাগ কিংবা পুলিশ কারো কোনো আগ্রহ নেই। আমরা ভুক্তভোগীরা বারবার অভিযোগ করছি, কিন্তু সমাধান নেই।”
ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ
মিটার চুরি হলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ গ্রাহকদের। মিটার ছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। অথচ নতুন মিটার স্থাপনের প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ। ফলে মানুষ চোরদের মুক্তিপণ দিয়েই পুরোনো মিটার ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক পরিবার বিদ্যুৎ সংযোগ হারিয়ে অন্ধকারে রাত কাটাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে মিল-কারখানা বা বড় গ্রাহকদের জন্য তিন-ফেজ মিটার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিদ্যুৎ বিভাগের বক্তব্য
চুয়াডাঙ্গা জোনাল ও মেহেরপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডিজিএম মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন,
“চুরি হওয়া মিটার কোথাও ব্যবহার করা যাবে না। এগুলো পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড থেকে সিল করা থাকে। সিল ব্রেক করলে সেটা অকেজো হয়ে যায়। অর্থাৎ চোরেরা এগুলো কাজে লাগাতে পারবে না। কিন্তু মাঝখানে গ্রাহকদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করছে, যা এক ধরনের প্রতারণা।”
তিনি আরও জানান, অভিযোগ পাওয়া মাত্রই গ্রাহকদের নতুন মিটার দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে এত সংখ্যক চুরির কারণে চাহিদা বেড়ে গেছে, তাই সবাইকে একসঙ্গে মিটার দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশের পদক্ষেপ
চুয়াডাঙ্গার সিআইসি পরিদর্শক মোহাম্মদ সামসুদ্দোহা বলেন,
“মিটার চুরির ঘটনাগুলো খুবই গুরুতর। আমরা একাধিক টিম নিয়ে মাঠে কাজ করছি। খুব শিগগিরই চক্রটিকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।”
তবে এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।
মেহেরপুরেও একই চিত্র
শুধু চুয়াডাঙ্গায় নয়, পাশের জেলা মেহেরপুরেও একই কায়দায় মিটার চুরির ঘটনা ঘটছে। বারাদি, আমঝুপি ও চাঁদবিল এলাকায় গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত কয়েক ডজন মিটার চুরির অভিযোগ উঠেছে। এখানেও একইভাবে মুক্তিপণ দাবি করছে চোরচক্র।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের অপরাধ দমন করতে হলে প্রযুক্তি নির্ভর সমাধান দরকার। মিটারগুলোতে জিপিএস বা বিশেষ ট্র্যাকিং সিস্টেম যুক্ত করলে চুরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি পুলিশের টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে।
এছাড়া জনগণকে সচেতন হতে হবে যাতে মুক্তিপণ দিয়ে চোরদের উৎসাহিত না করা হয়। বরং দ্রুত অভিযোগ করে আইনের আশ্রয় নেওয়া উচিত।
চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে বৈদ্যুতিক মিটার চুরি এখন বড় সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। চোরচক্রের অভিনব কৌশলে সাধারণ গ্রাহকরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এ ধরনের অপরাধ আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিদ্যুৎ বিভাগ, পুলিশ ও প্রশাসনের সমন্বিত পদক্ষেপ এবং জনগণের সহযোগিতাই পারে এই চক্রকে নির্মূল করতে।
MAH – 12898 I Signalbd.com