বাংলাদেশ

নতুন কেনা ইঞ্জিনগুলো বসে আছে, যাত্রীসেবা বাড়ানো যাচ্ছে না

অনুযায়ী ট্রেন চলাচল করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে নতুন কেনা ৩০টি ইঞ্জিনের মধ্যে ৯টি এখনও ব্যবহারযোগ্য নয়, যা যাত্রীসেবা বাড়ানোর পরিকল্পনাকে ব্যাহত করছে। রেল কর্তৃপক্ষের মতে, এগুলো সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই কেনা হয়েছিল।

৩০টি নতুন ইঞ্জিন কেনার পরও সংকট

২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে ৩০টি নতুন মিটারগেজ ইঞ্জিন আমদানি করে। প্রথম ধাপে ২০২১ সালে ১০টি ইঞ্জিন দেশে আসে, যার খরচ হয়েছিল ২৯৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। পরে দ্বিতীয় ধাপে আরও ২০টি ইঞ্জিন কেনা হয়, যার খরচ হয়েছিল ৮৪১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। মোট মিলিয়ে খরচ হয়েছিল ১ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা

তবে এই ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে ৯টি এখনও ব্যবহারযোগ্য নয়। মূল সমস্যাগুলো হলো:

  • ইঞ্জিনের ওজন বেশি হওয়া
  • পুরোনো সেতু এবং রেললাইনের ভার বহনে অক্ষমতা
  • স্টেশন শেডের উচ্চতার সঙ্গে অসঙ্গতি

রেলের মেকানিক্যাল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পুরোনো ভারী ইঞ্জিনগুলোর গড় ওজন ৭০–৭২ টন, যেখানে নতুন ইঞ্জিনের ওজন ৯০–৯৫ টন। ফলে অনেক পুরনো রেললাইনে এই নতুন ইঞ্জিন চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

কোন রুটে সমস্যা হচ্ছে?

রেলের অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলোতে নতুন ইঞ্জিন ব্যবহার করা যাচ্ছে না:

  1. ঢাকা-ময়মনসিংহ-জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ
  2. ঢাকা-ভৈরব-গৌরীপুর-ময়মনসিংহ
  3. চট্টগ্রাম-সিলেট
  4. চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ
  5. ঢাকা-নোয়াখালী
  6. ঢাকা-সিলেট

এছাড়া কালুরঘাট রেলওয়ে সেতু, ভৈরব পুরনো সেতু, কুশিয়ারা সেতু, ঘোড়াশাল (আপ) সেতু, শম্ভুগঞ্জ সেতু, ঘুমঘাট সেতু এবং ছাতক-সিলেট রুটের ২৮ নম্বর সেতুতে নতুন ইঞ্জিন চালানো যাচ্ছে না।

রেলের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, নতুন ইঞ্জিনের হুইল বড় এবং ক্যাপের উচ্চতা কম, ফলে ট্রেনচালক সিট থেকে উঠে দাঁড়ালে মাথা ছাদে লেগে যায়। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দেওয়ানগঞ্জ এবং কুলাউড়া স্টেশনের শেডের উচ্চতা নতুন ইঞ্জিনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

রেলের বিদ্যমান ইঞ্জিন ও চাহিদার পার্থক্য

বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিবহন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রেলের মোট ১৫৯টি মিটারগেজ ইঞ্জিন রয়েছে। দৈনিক ইঞ্জিনের চাহিদা ১১৬টি, কিন্তু বিভিন্ন ত্রুটির কারণে নিয়মিত মাত্র ১০০–১০৫টি ইঞ্জিন চালানো সম্ভব। এর ফলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলোতে পর্যাপ্ত ট্রেন সার্ভিস চালু করা যায় না।

নতুন ইঞ্জিনগুলোর ব্যবহার পরিস্থিতি

নতুন ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে:

  • ১১টি ইঞ্জিন চালানো হচ্ছে আন্তনগর যাত্রীবাহী ট্রেনে, যেমন:
    • চট্টগ্রাম-চাঁদপুর-চট্টগ্রাম
    • চট্টগ্রাম-ঢাকা-চট্টগ্রাম
    • ঢাকা-পার্বতীপুর-দিনাজপুর-পঞ্চগড়
    • ঢাকা-রাজশাহী
  • ১০টি ইঞ্জিন ব্যবহার হচ্ছে পণ্যবাহী ট্রেনে
  • বাকি ৯টি ইঞ্জিন জরুরি যন্ত্রাংশ এবং মেরামতের অধীনে রাখা হয়েছে

সম্প্রতি চাঁদপুর রুটে একটি ট্রেন চালু করা হয়েছে, তবে বাকি গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলোতে সমস্যার কারণে নতুন ইঞ্জিন ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

কেন এমন সমস্যা?

রেলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন ইঞ্জিন আমদানি করার আগে কোন রুটে ইঞ্জিন চলবে এবং কোন স্টেশনে থামবে তা যাচাই করা হয়নি। ফলে কর্মকর্তারা এগুলো উপযোগী কিনা তা আগে থেকেই বলতে পারেননি।

রেলের ইঞ্জিন ও বগি কেনাসংক্রান্ত প্রকল্প পরিচালক ফকির মো. মহিউদ্দিন জানান, “এই প্রকল্পটি আমার সময়ে হয়নি। ইঞ্জিনগুলোর ওয়ারেন্টি পিরিয়ডও শেষ। সব রুটে উপযোগিতা না থাকায় এগুলো এখনও চলাচল করতে পারছে না।”

সম্ভাব্য সমাধান

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য কয়েকটি বিষয় করা জরুরি:

  1. পুরনো সেতু ও রেললাইন শক্তিশালী করা – ভারী ইঞ্জিন চালানোর জন্য পুরনো সেতু সংস্কার করা প্রয়োজন।
  2. স্টেশন শেডের উচ্চতা বাড়ানো – নতুন ইঞ্জিনের উচ্চতা অনুযায়ী প্ল্যাটফর্ম ও শেড উন্নত করা।
  3. ইঞ্জিনের রুট পরিকল্পনা পুনঃনির্ধারণ – সম্ভাব্য রুট এবং গন্তব্যের জন্য প্রয়োজনীয় যাচাই নিশ্চিত করা।
  4. মেরামত ও অংশ প্রতিস্থাপন – যেসব ইঞ্জিন মেরামতের জন্য রাখা হয়েছে, দ্রুত কার্যকর করা।

এই উদ্যোগগুলো না নিলে দেশের রেলযাত্রীদের সুবিধা বাড়ানো এবং সময়মতো ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।

বিশ্লেষক মতামত

রেল বিশ্লেষকরা বলছেন, “বৃহৎ প্রজেক্টে কারিগরি বিশ্লেষণ ও সম্ভাব্যতা যাচাই অপরিহার্য। শুধুমাত্র ইঞ্জিন কিনে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। নতুন ইঞ্জিন চালু করার আগে রুট ও অবকাঠামো যাচাই করা উচিত ছিল।”

তাদের মতে, এমন ত্রুটি ভবিষ্যতের প্রকল্পের জন্য সতর্কতার সংকেত। এছাড়া, যাত্রীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা এবং সার্ভিসের ঘাটতি রেলওয়ের প্রতি মানুষের আস্থা কমাচ্ছে।

সামগ্রিক অবস্থা

বর্তমানে বাংলাদেশের রেলওয়ে নতুন প্রযুক্তি ও ইঞ্জিনের দিক থেকে উন্নতি করছে। তবে নিরীক্ষা, পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের ঘাটতি নতুন ইঞ্জিনের কার্যকারিতা সীমিত করছে।

বৃহত্তর রেল রুটগুলোতে চলাচলের জন্য:

  • ৩০টি নতুন ইঞ্জিনের মধ্যে অর্ধেক ব্যবহারযোগ্য
  • ৯টি ইঞ্জিন এখনও বসে আছে
  • পুরনো ৩০–৬০ বছরের ইঞ্জিনগুলোও অত্যন্ত দুর্বল

এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, দেশের রেল খাতকে উন্নত করতে পরিকল্পনা ও কারিগরি সমন্বয় অপরিহার্য

নতুন ইঞ্জিন কিনে থাকলেও কারিগরি ও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে বাংলাদেশের রেলওয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এখনও বাধা রয়েছে। যাত্রীসেবা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা, মেরামত ও অবকাঠামো উন্নয়ন, যা ছাড়া নতুন ইঞ্জিনের কার্যকারিতা সীমিত থাকবে।

MAH – 12885  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button