বাংলাদেশ

রাজধানীতে ডিএনসি’র বিশেষ অভিযান: বনানীর দুটি বারে বিপুল সিসা জব্দ

অভিযান ও ঘটনার বিবরণ

রাজধানীর বনানীতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) বিশেষ অভিযানে বিপুল পরিমাণ সিসা (শিসা বা হুক্কা তামাক) জব্দ করা হয়েছে। বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে শুরু হয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত চলা এ অভিযানে বনানীর জনপ্রিয় দুটি শিসা বার—আল গেসিনোহাবানা—এ একযোগে তল্লাশি চালানো হয়।

অভিযান শেষে সংবাদ সম্মেলনে ডিএনসি’র অতিরিক্ত পরিচালক এ কে এম শওকত ইসলাম জানান—আল গেসিনো বারে প্রায় সাড়ে ১০ কেজি সিসা, ১০ প্যাকেট কয়লা এবং বিভিন্ন শিসা সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। অপরদিকে হাবানা বারে প্রায় সাড়ে ৪ কেজি সিসা জব্দ করা হয়।

এ সময় হাবানা বারের ভেতর থেকে মিরাজ ও রিজভি নামের দুই ব্যক্তিকে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা প্রক্রিয়াধীন।

শিসা বা সিসা আসলে কী?

‘শিসা’ (Shisha) মূলত এক ধরনের তামাকজাত দ্রব্য যা ফ্লেভারযুক্ত তামাক, গ্লিসারিন ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে তৈরি হয়। এটি সাধারণত হুক্কা বা ওয়াটার পাইপে টেনে ধূমপান করা হয়। বাইরে থেকে দেখলে এটি নিরীহ মনে হলেও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন—

  • এক ঘণ্টা শিসা সেবন মানে প্রায় ১০০টি সিগারেট ধূমপানের সমান ক্ষতি
  • এতে থাকে নিকোটিন, টার, কার্বন মনোক্সাইডসহ নানা ধরনের ক্যানসার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক।
  • দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুসের ক্যানসার, হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, এমনকি প্রজনন সমস্যা সৃষ্টি করে।

তরুণ সমাজে শিসার জনপ্রিয়তা

রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা এমনকি চট্টগ্রাম, সিলেটের মতো শহরগুলোতে শিসা বার সংস্কৃতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

  • অনেক তরুণ এটিকে ‘ফ্যাশন’ বা ‘মডার্ন লাইফস্টাইল’-এর অংশ মনে করছে।
  • রঙিন পরিবেশ, ফ্লেভারের বৈচিত্র্য ও ক্যাফে সংস্কৃতির সঙ্গে মিল থাকায় শিক্ষার্থীরা সহজেই আকৃষ্ট হচ্ছে।
  • অনেক অভিভাবকও জানেন না, তাদের সন্তানরা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা শিসা টানছে।

আইনের দৃষ্টিতে শিসা

বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী শিসা বা সিসা মাদকদ্রব্য হিসেবে নিষিদ্ধ।

  • আইন অনুযায়ী শিসা রাখা, বিক্রি, পরিবেশন বা সেবন সবই অপরাধ।
  • এর শাস্তি সর্বনিম্ন ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।

তবে বাস্তবে অনেক ক্যাফে ও রেস্টুরেন্ট এখনও গোপনে শিসা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ডিএনসি নিয়মিত অভিযান চালালেও চাহিদা বেশি থাকায় শিসা সংস্কৃতি পুরোপুরি নির্মূল করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

পূর্ববর্তী অভিযান ও প্রেক্ষাপট

শুধু বনানী নয়, এর আগে ডিএনসি রাজধানীর গুলশান, ধানমন্ডি, বসুন্ধরা এবং বনশ্রী এলাকায় একাধিক শিসা বার থেকে বিপুল পরিমাণ শিসা জব্দ করেছে।

  • ২০২৩ সালে ধানমন্ডির এক ক্যাফে থেকে ২০ কেজিরও বেশি শিসা ফ্লেভার উদ্ধার করা হয়েছিল।
  • ২০২৪ সালে গুলশানে এক অভিজাত রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকার শিসা জব্দ হয়।

এরপরও দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন নামে শিসা বার আবার খুলছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত

ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক শ্বাসযন্ত্র বিশেষজ্ঞ জানালেন—

“অনেকেই মনে করেন শিসা পানিতে ফিল্টার হওয়ায় ক্ষতিকর নয়। কিন্তু গবেষণা বলছে পানির মাধ্যমে কোনো ক্ষতিকর পদার্থই কমে না, বরং শরীরে দীর্ঘ সময় ধরে জমে আরও ভয়ঙ্কর ক্ষতি করে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন—শিসার কারণে অনেক তরুণ আসক্ত হয়ে পড়ে এবং পরে সহজেই মাদকদ্রব্য যেমন ইয়াবা, গাঁজা, আইস-এর দিকে ঝুঁকে যায়।

ডিএনসি’র ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ডিএনসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে—

  • রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় গোপন ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট ও বারে নিয়মিত অভিযান চালানো হবে।
  • শুধু অভিযান নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করা হবে।
  • বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে এই ভয়ঙ্কর আসক্তি থেকে দূরে রাখতে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে।

সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া

অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অনেকেই বলছেন—

  • “শিসা শুধু মাদক নয়, এটা এক ধরনের সামাজিক রোগ।”
  • “ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টের আড়ালে যেভাবে তরুণদের ধ্বংস করা হচ্ছে, তা রোধ করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”
  • কেউ কেউ আবার অভিযোগ করেছেন, নিয়মিত অভিযান না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা বারবার ফিরে আসছে।

বনানীতে ডিএনসি’র এ অভিযান আবারও প্রমাণ করল—রাজধানীতে শিসা সংস্কৃতি ভয়াবহ হারে বিস্তার লাভ করেছে। যদিও আইন রয়েছে, তবে প্রয়োগ আরও কঠোর না হলে তরুণ সমাজকে এই মারাত্মক আসক্তি থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

শুধু অভিযান নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী সচেতনতা, কড়া নজরদারি ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে শিসা সংস্কৃতিকে নির্মূল করা। অন্যথায় আগামী প্রজন্ম এক ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়বে।

MAH – 12879  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button