
বাংলাদেশের লজিস্টিকস ও শিপিং খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ আসতে যাচ্ছে। ইতালিভিত্তিক বিশাল শিপিং প্রতিষ্ঠান মেডিটারেনিয়ান শিপিং করপোরেশন (MSC) এই বছর শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। এটি অনুমোদিত হলে দেশের অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার পরিবহন ব্যবস্থা এবং লজিস্টিকস খাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।
কোম্পানিটি চট্টগ্রামের পানগাঁও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল (পিআইসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বর্তমানে বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
MSC-এর বাংলাদেশ শাখার পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ
সরবরাহ ও লজিস্টিকস খাতের বিশেষজ্ঞ সংবাদমাধ্যম দ্য লোডস্টার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে MSC-এর বাংলাদেশ শাখার প্রধান হারুন রশিদ জানিয়েছেন, অনুমোদন পেলে এই বিনিয়োগ নতুন ধরনের পরিষেবা উন্নয়নে ব্যবহার করা হবে। এই পরিষেবার মধ্যে থাকবে:
- লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা
- কনসোলিডেশন সার্ভিস
- সম্পূর্ণ এন্ড-টু-এন্ড সার্ভিস
হারুন রশিদ বলেন, “এই নতুন সেবাগুলো প্রদানের পরিকল্পনা আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। আমরা আশা করি, চুক্তিটি শিগগিরই সই হয়ে যাবে।”
বার্জ সার্ভিস এবং চট্টগ্রাম বন্দরের চাপ কমানোর পরিকল্পনা
MSC-এর লজিস্টিকস বিভাগ পানগাঁও এবং চট্টগ্রামের মধ্যে বার্জ সার্ভিস চালু করার পরিকল্পনা করছে। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে চলমান ভিড় কমানো সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, “টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা প্রাথমিকভাবে স্থানীয় বার্জ ব্যবহার করব, যা বর্তমানে পানগাঁও এবং চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো পরিবহন করছে। পরবর্তীতে বিদেশ থেকে বার্জ আনার পরিকল্পনা রয়েছে।”
এই উদ্যোগের ফলে কনটেইনারগুলো সরাসরি ফিডার জাহাজ ও বার্জে লোড করা হবে, যার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের স্থলব্যবস্থা আরও কার্যকর হবে। শিপমেন্টগুলো ফিডারের মাধ্যমে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং শ্রীলঙ্কা সহ আঞ্চলিক গেটওয়েতে পাঠানো হবে।
২০ বছরের টার্মিনাল লিজ: সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষায়
বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা টার্মিনাল লিজ (ইজারা) দেওয়ার প্রস্তাবটি মূল্যায়ন করছেন। অনুমোদিত হলে MSC ২০ বছরের জন্য পানগাঁও টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পাবে।
প্রাথমিকভাবে এখানে ১ লাখ ১৬ হাজার ২০ ফুটি সমমানের কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা তৈরি করা হবে। তবে ভবিষ্যতে এটি বৃদ্ধি করে ১ লাখ ৬০ হাজার ইউনিট পর্যন্ত নেওয়া হবে।
নৌ–পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, “টার্মিনাল লিজ দেওয়ার পরিকল্পনা আমাদের আছে, যাতে এর ব্যবহার বাড়ানো যায় এবং নদীর মাধ্যমে কার্গো বহন বাড়ানো সম্ভব হয়। আমরা MSC-এর সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছি।”
পানগাঁও টার্মিনালের বর্তমান চ্যালেঞ্জ
পানগাঁওতে বন্দর সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বাজে ব্যবস্থাপনার কারণে এটি কার্যকরভাবে ব্যবহার হয়নি। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে চলমান সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।
২০২৩ সালে টার্মিনাল মোট ক্ষমতার মাত্র এক-চতুর্থাংশ ৩৫,৭৭১ ইউনিট হ্যান্ডেল করতে পেরেছে। পরের বছর মাত্র ১০,২৪০ ইউনিট পরিচালিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, MSC-এর বিনিয়োগ ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা পানগাঁও টার্মিনালকে বাংলাদেশের লজিস্টিকস খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।
MSC-এর আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশে সম্ভাবনা
MSC (Mediterranean Shipping Company) বিশ্বে কনটেইনার পরিবহন খাতের অন্যতম জায়ান্ট। তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কনটেইনার পরিবহন, লজিস্টিকস, কনসোলিডেশন এবং এন্ড-টু-এন্ড সার্ভিসের মান বৃদ্ধি পাবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, MSC-এর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বাজারে আসলে স্থিতিশীলতা, সময়োপযোগী পরিষেবা, এবং কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে।
বাংলাদেশে লজিস্টিকস খাতের সম্ভাবনা
বাংলাদেশ গভীর সমুদ্র বন্দরসহ দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিকস কেন্দ্র হতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দর ও পানগাঁও টার্মিনালকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করলে:
- কার্গো পরিবহন দ্রুত হবে
- স্থানান্তর খরচ কমবে
- আন্তর্জাতিক রপ্তানি ও আমদানি প্রক্রিয়া সহজ হবে
- স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ বৃদ্ধি পাবে
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, MSC-এর এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে, বিশেষ করে রপ্তানি খাত ও লজিস্টিকস খাতে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও বাংলাদেশে প্রভাব
MSC-এর বিনিয়োগের ফলে পানগাঁও টার্মিনালকে আধুনিকায়ন করা সম্ভব হবে। এতে:
- লজিস্টিকস ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে
- চট্টগ্রাম বন্দরের চাপ কমবে
- নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে
- নদী ও সমুদ্রপথে কার্গো পরিবহনে নতুন দিগন্ত খুলবে
এছাড়া, ভবিষ্যতে ফিডার জাহাজ ও বার্জ ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশকে আঞ্চলিক লজিস্টিকস হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের লজিস্টিকস খাতের জন্য MSC-এর বিনিয়োগ একটি বড় সুযোগ। পানগাঁও টার্মিনালকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করলে চট্টগ্রাম বন্দরের চাপ কমানো সম্ভব হবে, আন্তর্জাতিক মানের লজিস্টিকস সার্ভিস চালু করা সম্ভব হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সরকারের অনুমোদন ও MSC-এর কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের লজিস্টিকস খাত দ্রুত আধুনিকায়ন এবং আন্তর্জাতিক মানের সেবা নিশ্চিত করতে পারে।
MAH – 12870 Signalbd.com