৬ বছর বয়সী জমজ শিশুসহ নিহত আরও ৫১ ফিলিস্তিনি

অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজার রাজধানী গাজা সিটি যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সোমবার রাত থেকে টানা বোমাবর্ষণ চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। শুধু গত ২৪ ঘণ্টাতেই শহরজুড়ে অন্তত ৫১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছে একটি ছয় বছর বয়সী জমজ শিশু, নারী, বৃদ্ধ এবং তিনজন সাংবাদিক।
এই ভয়াবহ ঘটনার খবর নিশ্চিত করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। তারা জানিয়েছে, ইসরায়েল গাজার সবচেয়ে বড় আবাসিক ভবন আল-ঘাফরি হাইরাইজ ধ্বংস করেছে। বিশাল এই ভবন ধসে পড়ার পর পুরো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। আতঙ্কে লাখো বাসিন্দা শহর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন।
জাতিসংঘের অভিযোগ: অপ্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার করছে ইসরায়েল
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টার ফ্রান্সেসকা আলবানিজে জানিয়েছেন, গাজায় ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উৎখাত করতে ইসরায়েল অপ্রচলিত ও নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার করছে। তার ভাষায়—
“এটি কেবল যুদ্ধ নয়, এটি একটি পরিকল্পিত গণউৎখাত।”
এদিকে ইসরায়েলের টিভি চ্যানেল ১২ স্বীকার করেছে, গাজা সিটির উত্তর ও পশ্চিম অংশে “অস্বাভাবিক তীব্র হামলা” চালানো হয়েছে।
ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স বলছে, গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত ৫০টি বহুতল ভবন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। শুধু জায়তুন এলাকায় আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে প্রায় ১,৫০০ বাড়িঘর।
সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ
ফিলিস্তিনের সাংবাদিকদের ওপর হামলার মাত্রাও ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নিহত হয়েছেন আরও তিনজন গণমাধ্যমকর্মী। তারা হলেন—
- প্রতিবেদক মোহাম্মদ আল-কুইফি
- ফটোগ্রাফার ও সম্প্রচার প্রকৌশলী আইমান হানিয়ে
- সাংবাদিক ইমান আল-জামিলি
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৮০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এটি সাংবাদিকদের জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
শিশু ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু থামছেই না
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত শুধু গাজা সিটিতে নিহত হয়েছেন ৫১ জন। নিহতদের মধ্যে ছয় বছরের জমজ শিশুও রয়েছে।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনিদের জন্য এক মহাদুর্যোগে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী—
- ৬৪ হাজার ৯০৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত
- ১ লাখ ৬৪ হাজার ৯২৬ জন আহত
- ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অগণিত মরদেহ চাপা পড়ে আছে
আবাসিক ভবন ও হাসপাতাল টার্গেট
গত ২৩ মাসে ইসরায়েলের হামলায় আবাসিক ভবন, স্কুল, হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা একের পর এক ধ্বংস হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ একটি ভিডিও প্রকাশ করে বলেন—
“সন্ত্রাসের টাওয়ার সমুদ্রে ভেঙে পড়েছে।”
তবে সেই ভবনটি আসলেই হামাসের ব্যবহৃত ছিল কিনা, তার কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি তিনি।
গাজার মানবিক বিপর্যয়
গাজায় এখন মানবিক বিপর্যয় চরম আকার নিয়েছে।
- লাখো মানুষ পানি ও খাবারের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে।
- চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়েছে, ওষুধের মারাত্মক সংকট।
- স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে হাজারো মানুষ।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় এখন কার্যত মানবিক সহায়তার প্রবেশও বন্ধ হয়ে গেছে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ: বিশ্ব প্রতিক্রিয়া
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গাজায় হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।
- জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “এই যুদ্ধ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।”
- তুরস্ক ও কাতার তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়েছে।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, গাজায় এখন মানবিক বিপর্যয় প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মহলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
২৩ মাস ধরে চলমান এই যুদ্ধে গাজার সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ হারাচ্ছে প্রিয়জনকে। বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যু ও তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ পুরো বিশ্বকে নাড়া দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য বেঁচে থাকার লড়াই ততই কঠিন হয়ে উঠবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ কার্যকর না হলে গাজা পুরোপুরি একটি বাসযোগ্যতাহীন মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে।
গাজায় ৬ বছর বয়সী জমজ শিশুসহ ৫১ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার ঘটনা শুধু একটি সংবাদ নয়, বরং মানবতার জন্য গভীর প্রশ্ন। যুদ্ধের নামে নিরীহ মানুষ, শিশু, সাংবাদিকদের জীবন কেড়ে নেওয়া কোনোভাবেই ন্যায্য নয়। বিশ্ব শক্তিগুলোর উচিত এখনই পদক্ষেপ নেওয়া, নইলে এই রক্তাক্ত অধ্যায় আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
MAH – 12838 Signalbd.com