যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ভেনেজুয়েলার নৌযান ডুবে গেলো, নিহত ৩

দক্ষিণ ক্যারিবীয় সাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় আবারও ভেনেজুয়েলার একটি নৌযানকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী। অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত তিনজন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, নৌযানটি মাদক পাচারে জড়িত ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলছিল।
এটি মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় হামলা, যা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর আগে একই অঞ্চলে অন্য এক মাদকবাহী নৌযানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে প্রাণ হারান কমপক্ষে ১১ জন।
হামলার ঘটনা ও মার্কিন যুক্তি
মার্কিন প্রশাসন জানায়, ভেনেজুয়েলা থেকে পরিচালিত আন্তর্জাতিক মাদক চক্র ক্যারিবীয় সাগরের জলসীমা ব্যবহার করে নিয়মিত কোকেন ও অন্যান্য মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করছে। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ধ্বংস করা নৌযানটি বিপুল পরিমাণ অবৈধ কোকেন বহন করছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে বলেন—
“যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে মাদক সন্ত্রাস থেকে রক্ষা করতে আমরা শূন্য সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করেছি। ভেনেজুয়েলা থেকে মাদক পাচার আর সহ্য করা হবে না।”
ভেনেজুয়েলার প্রতিক্রিয়া
অন্যদিকে, ভেনেজুয়েলার সরকার এই হামলাকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে। ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন—
“আমাদের নৌযানকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় আক্রমণ করা একটি আগ্রাসী পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে।”
ভেনেজুয়েলা সরকারের দাবি, নৌযানটি মাদক বহন করছিল না। এটি ছিল একটি বাণিজ্যিক জাহাজ, যেটিকে যুক্তরাষ্ট্র ভুলভাবে ‘মাদকবাহী’ আখ্যা দিয়েছে।
কেন ভেনেজুয়েলা মাদক পাচারের কেন্দ্রবিন্দু?
ভেনেজুয়েলা বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম প্রধান মাদকপাচার রুট হিসেবে পরিচিত। এর ভূগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং দুর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করেছে।
- কোকেন উৎপাদন: বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কোকেন উৎপাদন হয় কলম্বিয়ায়। ভেনেজুয়েলা হচ্ছে এর প্রধান ট্রানজিট রুট, যেখান থেকে মাদক পাচার হয় ক্যারিবীয় অঞ্চলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে।
- দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক সংকট: দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অবনতির কারণে ভেনেজুয়েলার বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় দুর্নীতি ব্যাপক। মাদক চক্র সহজেই এসব দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছে।
- সামরিক সম্পৃক্ততার অভিযোগ: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভেনেজুয়েলার কিছু সামরিক কর্মকর্তা নিজেরাই মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান
২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যে, তারা “Operation Caribbean Shield” নামে একটি বিশেষ অভিযান চালু করেছে। এর আওতায়—
- ৪,৫০০-এর বেশি মার্কিন নৌসেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
- আধুনিক ডেস্ট্রয়ার, অ্যাটাক সাবমেরিন, নজরদারি বিমান ও যুদ্ধজাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে।
- ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের বেশ কয়েকটি দেশ এ অভিযানে সহযোগিতা করছে।
এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হলো মাদক চক্রকে দমন করা, পাচার রুট ধ্বংস করা এবং যুক্তরাষ্ট্রে মাদকের প্রবাহ বন্ধ করা।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনাকে ঘিরে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
- একদিকে মাদক দমন জরুরি হলেও, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় সামরিক হামলা কূটনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে।
- লাতিন আমেরিকার দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপ বাড়াচ্ছে।
- মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এ ধরনের হামলায় সাধারণ জেলেদেরও ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলা সম্পর্ক
ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার সম্পর্ক তলানিতে।
- যুক্তরাষ্ট্র বহুবার ভেনেজুয়েলার সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
- ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ‘অবৈধ শাসক’ হিসেবে অভিহিত করেছে ওয়াশিংটন।
- অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে দেশটির সাধারণ মানুষ চরম কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সংকট
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই হামলার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও অবনতি হতে পারে।
- ভেনেজুয়েলা যদি পাল্টা পদক্ষেপ নেয়, তবে ক্যারিবীয় অঞ্চলে সামরিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- আন্তর্জাতিক আদালতে বিষয়টি তোলার সম্ভাবনাও রয়েছে।
- মাদক চক্র দমন না হয়ে বরং আরও সহিংস হয়ে উঠতে পারে, কারণ তারা নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠবে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
লাতিন আমেরিকা বিষয়ক গবেষক ড. হুয়ান কার্লোস বলেন—
“যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের হামলা স্বল্পমেয়াদে মাদক ব্যবসা ব্যাহত করতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়। ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক সংকট, দারিদ্র্য ও দুর্নীতি না কমালে মাদক ব্যবসা থামানো সম্ভব হবে না।”
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক এই সামরিক পদক্ষেপ মাদকবিরোধী যুদ্ধকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তবে এটি একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক কূটনীতির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যারিবীয় সাগরে উত্তেজনা বেড়ে গেলে শুধু ভেনেজুয়েলা নয়, পুরো লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
MAH – 12837 Signalbd.com