ডেঙ্গুতে আরও ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৬৩৬

দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি, নতুন করে ৬৩৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ডেঙ্গু জ্বর, যা মূলত এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়, এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, গরম এবং বর্ষার পরবর্তী মৌসুমে ডেঙ্গু আরও বিস্তার লাভ করতে পারে, যদি সময়মতো সচেতনতা বৃদ্ধি না পায়।
চলতি বছরে ডেঙ্গুর পরিসংখ্যান
এই ঘটনার ফলে চলতি বছরের ডেঙ্গু সংক্রান্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৫ জন। এছাড়া, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া মানুষের মোট সংখ্যা বেড়ে ৩৮,৫২৭ জন হয়েছে।
মৃতদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে দুজন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে দুজন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে একজন অন্তর্ভুক্ত। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, রোগীদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তড়িঘড়ি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ডেঙ্গুর কারণে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা গত কয়েক সপ্তাহে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এখনই সমন্বিত ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণহীন হতে পারে।
ডেঙ্গুর প্রভাব ও ঝুঁকি
ডেঙ্গু শুধুমাত্র সাধারণ জ্বর নয়। এটি কখনও কখনও ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS)-এর মতো জীবনঘাতী জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
- হঠাৎ জ্বর
- তীব্র মাথাব্যথা
- চোখের পেছনের ব্যথা
- চামড়ায় দাগ
- নাক বা মাড়ি থেকে রক্তপাত
- মাথা, পেটে ও হাড়ের তীব্র ব্যথা
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, যদি উপরের লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা আবশ্যক। ঘরে বা আশেপাশে মশার প্রজনন ঠেকানো না গেলে রোগের বিস্তার অল্প সময়ের মধ্যে মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পদক্ষেপ
স্বাস্থ্য অধিদফতর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তৎপর রয়েছে। তারা নিয়মিত মশা নিধন অভিযান চালাচ্ছে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পেইন চালু করেছে।
অধিদফতর জানিয়েছে, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং খুলনা অঞ্চলে ডেঙ্গু ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এজন্য তারা হাসপাতালে পর্যাপ্ত ডেঙ্গু চিকিৎসা কিট, ভেন্টিলেটর এবং রক্তের পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।
অধিদফতরের নির্দেশে, সবাইকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তারা বলেছে:
- ঘর ও আশেপাশে পানি জমে না রাখুন
- মশারি বা মশার প্রতিরোধী স্প্রে ব্যবহার করুন
- জ্বর বা অস্বস্তির ক্ষেত্রে অবিলম্বে চিকিৎসা নিন
ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণের করণীয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে শুধু সরকারি পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
- খোলা পাত্রে পানি রাখবেন না, কারণ মশার লার্ভা সেখানে জন্মায়।
- কুলার, টব, ফুলের পাত্র এবং ড্রেনেজ লাইনে জমে থাকা পানি নিয়মিত খালি করুন।
- ঘরে মশারি ব্যবহার করুন এবং মশার প্রতিরোধী স্প্রে ব্যবহার করুন।
- ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট ছোট সতর্কতা গ্রহণ করলে ডেঙ্গুর বিস্তার অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে?
বাংলাদেশে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের পর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। এটি মূলত পরিবেশগত ও সামাজিক কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত।
- নগরায়ন ও জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি
- পানি নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা না থাকা
- আবহাওয়ার পরিবর্তন ও উষ্ণতায় মশার বিস্তার
এছাড়া, করোনার সময় স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে মানুষের মধ্যে শিথিলতা এবং মশা নিধন কার্যক্রমে ভাটা ডেঙ্গুর বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকার, স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সাধারণ মানুষ একত্রে কাজ করতে হবে।
আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ডেঙ্গু বড় একটি স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষাধিক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি। উন্নত দেশগুলো মশা নিয়ন্ত্রণ, সচেতনতা এবং টিকাদান কর্মসূচি এর মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে।
সতর্কবার্তা
স্বাস্থ্য অধিদফতর সকল নাগরিককে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলেছে। যদি কেউ জ্বর, মাথা ব্যথা, চোখে ব্যথা, তীব্র ক্লান্তি বা রক্তপাতের মতো উপসর্গ অনুভব করেন, তবে অবিলম্বে নিকটস্থ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যান।
তাদের বলা হয়েছে, ডেঙ্গুর দ্রুত পরীক্ষা ও প্রাথমিক চিকিৎসা জীবন রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডেঙ্গু শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক সমস্যা। সকলের সচেতনতা, নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সরকারের সঙ্গে সমন্বয়মূলক পদক্ষেপ নিলে এই রোগের বিস্তার অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো নিজের এবং পরিবার-পরিজনের স্বাস্থ্য রক্ষা করা। ছোট ছোট পদক্ষেপও ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
MAH – 12836 Signalbd.com