ঢাকা মেডিকেলে একসঙ্গে জন্ম নেওয়া ৬ নবজাতকের মধ্যে ৪ জনের মৃত্যু

রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে একসঙ্গে জন্ম নেয়া ছয় নবজাতকের মধ্যে চারজন মারা গেছে। মাত্র ২৭ সপ্তাহে জন্মানো এই নবজাতকরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় জন্ম নেয়। চিকিৎসকরা শুরু থেকেই জানিয়েছিলেন, এদের প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। অবশেষে দুঃসংবাদ সত্য হলো—দুই দিনে একে একে চার নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে।
কীভাবে ঘটলো এই বিরল জন্ম
রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকালে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার তরুণ গৃহবধূ মোকসেদা আক্তার প্রিয়া (২৩) ঢামেক হাসপাতালের গাইনি বিভাগের লেবার ওয়ার্ডে স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে তিন ছেলে ও তিন মেয়ের জন্ম দেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটিকে “সেক্সটুপ্লেটস” (Sextuplets) বলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরকম ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশে এমন নজির অত্যন্ত বিরল।
তবে সমস্যা ছিল শুরু থেকেই। গর্ভকাল স্বাভাবিকভাবে ৩৮ থেকে ৪০ সপ্তাহ পর্যন্ত হয়, কিন্তু প্রিয়ার সন্তানরা জন্ম নেয় মাত্র ২৭ সপ্তাহে। ফলে শিশুদের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম ছিল—যা তাদের শারীরিক জটিলতা আরও বাড়িয়ে তোলে।
মৃত্যু সংবাদ
প্রসবের পর থেকেই ছয় নবজাতককে ঢামেক হাসপাতালের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) ভর্তি করা হয়।
- প্রথম মৃত্যু ঘটে রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাত ৩টার দিকে। কাঁটাবনের একটি বেসরকারি হাসপাতালের এনআইসিইউতে চিকিৎসাধীন এক কন্যাশিশু মারা যায়।
- একই দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢামেক হাসপাতালের এনআইসিইউতে চিকিৎসাধীন আরেকটি শিশু মারা যায়।
- সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকাল সোয়া ১০টার দিকে আরও দুই নবজাতক মৃত্যুবরণ করে।
এখন জীবিত রয়েছে মাত্র দুই শিশু, তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
চিকিৎসকদের মতামত
ঢামেক হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, এত কম সময়ে (প্রি-ম্যাচিউর) জন্মানো শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত কঠিন।
- নবজাতকদের ফুসফুস সম্পূর্ণ গঠিত হয়নি
- ওজন অত্যন্ত কম (সাধারণত জন্মের সময় ২.৫ কেজি বা তার বেশি স্বাভাবিক ধরা হয়, কিন্তু এরা ৮০০ গ্রাম থেকে ১.২ কেজির মধ্যে ছিল)
- সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি
চিকিৎসকরা অক্সিজেন সাপোর্ট, ওষুধ এবং এনআইসিইউতে নিবিড় পরিচর্যা দিলেও প্রাণে বাঁচানো যায়নি চার নবজাতককে।
পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া
নবজাতকদের মা প্রিয়া এবং বাবা একজন সাধারণ ব্যবসায়ী। পরিবারে ছিল সীমিত আয়। হঠাৎ ছয় সন্তানের জন্ম তাদের জীবনে যেমন বিস্ময় নিয়ে আসে, তেমনি মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে সব স্বপ্ন। একে একে সন্তানদের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা।
প্রিয়ার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, “আমরা ভেবেছিলাম হয়তো একসঙ্গে এতগুলো সন্তান আসায় সবাই আল্লাহর রহমতে বেঁচে যাবে। কিন্তু এখন একে একে চারজন চলে গেল। আমরা বাকরুদ্ধ।”
বাংলাদেশে পূর্বের বিরল ঘটনা
বাংলাদেশে একসঙ্গে একাধিক শিশুর জন্মের কয়েকটি ঘটনা আগে ঘটলেও ছয় সন্তানের জন্ম অত্যন্ত বিরল।
- ২০১৯ সালে খুলনায় একসঙ্গে পাঁচ শিশুর জন্ম হয়েছিল, তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চারজন মারা যায়।
- ২০২১ সালে কুমিল্লায় একসঙ্গে চার সন্তানের জন্ম হয়েছিল, যাদের মধ্যে দুইজন বেঁচে ছিল।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছয় বা তার বেশি সন্তানের জন্মের ইতিহাস থাকলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্রি-ম্যাচিউর জন্মানোর কারণে দীর্ঘদিন চিকিৎসার অধীনে থাকে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের নবজাতক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন—
১. একাধিক শিশুর জন্ম হলে তাদের গর্ভে বেড়ে ওঠার সময় পুষ্টি ও অক্সিজেনের ঘাটতি হয়।
২. বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আগেভাগেই প্রসব হয়, ফলে নবজাতকদের শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পূর্ণভাবে গঠিত হয় না।
৩. এনআইসিইউ যতই উন্নত হোক না কেন, কম ওজন এবং অপূর্ণাঙ্গ ফুসফুস নিয়ে জন্মানো শিশুকে বাঁচানো অনেক সময় সম্ভব হয় না।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অনেকেই পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছেন, কেউ কেউ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন এমন জটিল পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সেবার মান আরও বাড়ানো হয়।
মায়ের শারীরিক অবস্থা
প্রসবের পর বর্তমানে মা প্রিয়া ঢামেক হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। পরিবার তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে কী শেখা যায়?
এই ঘটনার মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছেন—
- প্রসব-পূর্ব নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা (Antenatal Checkup) অত্যন্ত জরুরি।
- পুষ্টিকর খাদ্য ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা মা ও শিশুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- উন্নত মাতৃসেবা নিশ্চিত করতে হবে বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলেও।
ঢাকা মেডিকেলে জন্ম নেয়া ছয় নবজাতকের মধ্যে চারজনের মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য এক হৃদয়বিদারক সংবাদ। চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও অকালপ্রসব ও কম ওজনের কারণে নবজাতকদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এখনো দুই নবজাতক জীবিত আছে, তবে তাদের জীবনও ঝুঁকিতে রয়েছে।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অগ্রগতি সত্ত্বেও এ ধরনের ঘটনায় আমাদের আরও প্রস্তুত হওয়া দরকার। প্রতিটি মা যেন নিরাপদ মাতৃত্ব পান, প্রতিটি নবজাতক যেন সুস্থভাবে পৃথিবীর আলো দেখতে পারে—এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রার্থনা।
MAH – 12834 Signalbd.com