বাংলাদেশ

তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে: ব্যারাজের সব গেট খুলে সতর্ক করা হয়েছে

দেশের উত্তরাঞ্চলের অন্যতম প্রধান নদী তিস্তা আবারও বিপৎসীমার ওপরে পৌঁছেছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েক দিনের ভারী বর্ষণের কারণে তিস্তার পানি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকাল ৬টার দিকে তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে রেকর্ড করা পানি স্তর ৫২ দশমিক ১৮ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার উপরে।

পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ ব্যারাজের সব ৪৪টি জলকপাট খুলে রেখেছে। এর ফলে নদীর তীরে থাকা নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

পানি বৃদ্ধি: গত কিছুদিনের পরিস্থিতি

পাউবোর সূত্রে জানা গেছে, রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকাল ৬টায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার নিচে ছিল। দুপুরের পর থেকে পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। রাত ৯টায় এটি বিপৎসীমার মাত্র ৩ সেন্টিমিটার নিচে ছিল। সোমবার সকালে পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।

নীলফামারীর ডিমলা ও লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার নদীপাড়ের মানুষজন হঠাৎ পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে আতঙ্কিত। নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের কিছু জায়গায় পানি প্রবেশ করেছে, যা স্থানীয়দের মধ্যে জরুরি সতর্কতা সৃষ্টি করেছে।

স্থানীয়দের প্রভাব ও প্রস্তুতি

ডিমলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম বলেন, “তিস্তায় পানি ক্রমেই বেড়েই চলেছে। এখনো ঘরবাড়ি ডুবেনি, কিন্তু মানুষ উদ্বিগ্ন। আমাদের এলাকায় কৃষিজমি ও গবাদিপশুর জন্য উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। মানুষ তাদের সম্পদ সরানোর চেষ্টা করছে।”

নদীপাড়ের বাসিন্দারা গবাদিপশু, মূল্যবান জিনিসপত্র ও খাদ্যশস্য নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখার জন্য কাজ শুরু করেছেন। অনেকেই নৌকা ও চরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিশেষ করে চরাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, কারণ এখানে পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাড়িঘর ও ফসলি জমি প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবস্থান

ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, “উজানে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে তিস্তার পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সকাল ৬টা থেকে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যারাজের সব জলকপাট খোলা রাখা হয়েছে। আমরা পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছি এবং নদীপাড়ের মানুষদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি।”

তিনি আরও জানান, পানি বৃদ্ধির কারণে নদীর তীরে থাকা নিম্নাঞ্চলসমূহে বন্যা হতে পারে। এজন্য পাউবো স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাদের সঙ্গে সমন্বয় করে জরুরি ব্যবস্থার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ

বাংলাদেশে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (বাপাউবো) জানিয়েছে, আগামী তিন দিনে (১৪ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর) রংপুর বিভাগের প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এর মধ্যে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাপাউবো-এর পক্ষ থেকে নদীপাড়ের মানুষদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রামের নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলগুলোতে প্লাবনের আশঙ্কা রয়েছে।

নদীর প্রভাবিত এলাকা ও ক্ষয়ক্ষতি

নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুরের নিম্নাঞ্চলগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রেই পানি ইতোমধ্যেই বাড়ি ও খামার ভেদ করে প্রবেশ করেছে। ফসলি জমি, গবাদিপশু ও বসতবাড়ি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, পানি বৃদ্ধি রোধে ব্যারাজের জলকপাট খোলা থাকলেও, প্রাকৃতিক কারণের কারণে নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই চ্যালেঞ্জিং। পরিস্থিতি অবনতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।

ইতিহাসে তিস্তা নদীর বন্যা

তিস্তা নদী বরাবরই বন্যার জন্য পরিচিত। অতীতের ঘটনা অনুযায়ী, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের সময় নদীটি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং নদীপাড়ের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। ১৯৯৮ সালের বড় তিস্তা বন্যা, ২০০৪ সালের বন্যা এবং ২০১৭ সালের লালমনিরহাট ও নীলফামারীর নদীপাড় প্লাবিত হওয়ার ঘটনা এখনো মানুষের স্মৃতিতে তাজা।

পাবলিক ও প্রশাসনিক সহায়তায় নদীপাড়ের মানুষ এসব বন্যার জন্য প্রস্তুত থাকেন। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের unpredictability-এর কারণে সতর্কতা অবলম্বন অপরিহার্য।

প্রশাসনিক প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও উদ্ধারকারী দল সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে:

  • ব্যারাজের সব জলকপাট খোলা রাখা।
  • নদীপাড়ের মানুষদের সরানোর পরিকল্পনা প্রস্তুত।
  • আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা।
  • স্থানীয়দের জরুরি সতর্কতা ও নির্দেশনা প্রদান।
  • গবাদিপশু ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিরাপদ স্থানে সরানোর তাগিদ।

নদীপাড়ের মানুষের অভিজ্ঞতা

নদীপাড়ের মানুষদের জীবনে বন্যা সিজন মানেই আতঙ্ক। স্থানীয় কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, “আমাদের সব ফসল নদীর পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমাদের গবাদিপশু ও সরঞ্জাম নিয়ে নিরাপদ স্থানে যাতায়াত করতে হচ্ছে।”

অন্য এক বাসিন্দা বলেন, “প্রতি বছরই বন্যা হয়, কিন্তু এমন পানি বৃদ্ধি কখনো আগে হয়নি। আমরা আশা করছি প্রশাসন আমাদের সাহায্য করবে।”

সমন্বিত সতর্কতা ও পরামর্শ

পাউবো এবং বাপাউবো থেকে নদীপাড়ের মানুষদেরকে বলা হয়েছে:

  1. নদীর পানি বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
  2. জরুরি পরিস্থিতিতে পরিবার এবং সম্পদ দ্রুত সরাতে হবে।
  3. আশ্রয়কেন্দ্রের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
  4. শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদিপশুদের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করতে হবে।
  5. নদীপাড়ের মানুষদের মোবাইল এবং রেডিও মাধ্যমে নতুন সতর্কতা ও খবরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে।

উত্তরবাংলার তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে পৌঁছেছে এবং নদীপাড়ের নিম্নাঞ্চল প্লাবনের ঝুঁকিতে রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণ মিলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের unpredictability-এর কারণে সতর্ক থাকা, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া এবং নিরাপদ স্থানে অবস্থান করা অপরিহার্য।

এই পরিস্থিতি থেকে শেখার বিষয় হলো, নদী সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষদের সচেতন থাকা, প্রশাসনের নির্দেশনা মানা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

MAH – 12825  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button