আড়াই মাসে রিজার্ভে ১৩৯ কোটি ডলার যুক্ত করল বাংলাদেশ ব্যাংক

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে বৈশ্বিক অর্থনীতি অস্থির হয়ে পড়ে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। ২০২২ সাল থেকেই দেশে ডলারের দাম দ্রুত বাড়তে শুরু করে। সেই সময়ে প্রতি ডলারের দাম ছিল প্রায় ৮৫ টাকা। অল্প সময়ের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২২ টাকায়। এতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী—সবার জীবনযাত্রায় বাড়তি চাপ পড়ে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকে, আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, এবং অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক তখন বাজার স্থিতিশীল রাখতে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করে। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ের জোয়ারে স্বস্তি
গত দুই বছরে সরকার অর্থ পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। এর ফলে হুন্ডি কমে আসে এবং প্রবাসীরা আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী—
- ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে ৩০.৩২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি।
- চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই–আগস্ট) এসেছে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮.৪১ শতাংশ বেশি।
একই সময়ে রপ্তানি খাতেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। ২০২৪–২৫ অর্থবছর শেষে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৭.৭২ শতাংশ। পোশাক শিল্প, চামড়া, কৃষিপণ্য এবং আইটি খাতে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ: ডলার কেনার নতুন ধারা
যখন বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়, তখন সাধারণত ডলারের দাম কমে আসে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এবার ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। দাম যাতে খুব দ্রুত না কমে যায়, সেজন্য তারা বাজার থেকে ডলার কিনছে।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১৩৯ কোটি ডলার কিনেছে। এর ফলে—
- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে।
- ডলারের দাম ১২০ টাকার ওপরে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।
- বাজারের সরবরাহ ও চাহিদা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পদক্ষেপ মূলত রপ্তানিকারক ও প্রবাসী আয়কারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। কারণ, ডলারের দাম হঠাৎ কমে গেলে প্রবাসীরা আনুষ্ঠানিক পথে টাকা পাঠাতে অনীহা বোধ করতে পারেন। আবার রপ্তানিকারকরাও লোকসানে পড়তে পারেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)–এর শর্ত
বাংলাদেশ ২০২৩ সালে আইএমএফ থেকে ঋণ প্রোগ্রামে যুক্ত হয়। এর একটি বড় শর্ত ছিল—ডলারের দাম যেন বাজারনির্ভর হয়।
এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেকটা সেই পথেই যাচ্ছে। ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারের ওপর নির্ভর করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু নিলামের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করছে, যাতে দাম অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা না করে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৩০.৫৮ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের হিসাব (বিপিএম ৬) অনুযায়ী এটি ২৫.৬৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ২০.৫৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ রিজার্ভ বেড়েছে, যা সরকারের জন্য একটি ইতিবাচক সংকেত।
যদি ডলারের দাম কমতো
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, যদি তারা বাজার থেকে ডলার না কিনত, তাহলে দাম ১২০ টাকার নিচে নেমে আসত। এতে সাধারণ মানুষের জন্য ভালো হতো, কারণ মুদ্রাস্ফীতি কমে আসত।
তবে এতে আবার অন্য একটি সমস্যা দেখা দিত—
- রপ্তানিকারকরা কম আয়ের কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারতেন।
- প্রবাসী আয় কমে যেত, কারণ তারা কম দামে টাকা পাঠাতে চাইতেন না।
তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভারসাম্য বজায় রাখতে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে।
আমদানি খাতে চাপ
যদিও রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ছে, তবুও আমদানি খাতে চাপ রয়ে গেছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে আমদানি খরচ হয়েছে প্রায় ৬৮.৩৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২.৪৪ শতাংশ বেশি।
এখনো কিছু খাতে (বিশেষ করে জ্বালানি, সার, খাদ্যশস্য) আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। ফলে ডলারের চাহিদা পুরোপুরি কমে যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ডলার কেনা ও রিজার্ভ বাড়ানো স্বল্পমেয়াদে ভালো সিদ্ধান্ত হলেও দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই প্রধান চ্যালেঞ্জ।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন—
“ডলার-সংকট এখন নেই। ডলারের দামকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। দাম কিছুটা কমলে টাকার মান বাড়বে, মুদ্রাস্ফীতি কমবে। এতে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে।”
তবে তিনি এটিও স্বীকার করেন, খুব বেশি কমে গেলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে এখন তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে—
- মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: দাম নিয়ন্ত্রণ না হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠবে।
- রপ্তানি বৈচিত্র্য: পোশাক শিল্পের বাইরে নতুন খাতে রপ্তানি বাড়ানো দরকার।
- প্রবাসী আয়ের টেকসই প্রবাহ: হুন্ডি প্রতিরোধ এবং বৈধ পথে টাকা পাঠানোর জন্য প্রযুক্তি ও নীতিগত সহায়তা জোরদার করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আড়াই মাসে ১৩৯ কোটি ডলার কিনে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা দেশের রিজার্ভকে শক্তিশালী করছে এবং ডলারের দামকে স্থিতিশীল রাখছে। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের জন্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারকে আরও স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের স্থায়ী প্রবাহ নিশ্চিত হলে বাংলাদেশ অর্থনীতি আরও দৃঢ় অবস্থানে পৌঁছাবে।
MAH – 12820 Signalbd.com