মিশর চায় ন্যাটোর মতো আরব সামরিক জোট

মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও নতুন মোড় নিচ্ছে। মিশর ঘোষণা দিয়েছে, তারা ন্যাটোর আদলে একটি আঞ্চলিক সামরিক জোট গঠন করতে চায়। প্রস্তাবিত জোটের সদর দপ্তর হবে কায়রোতে এবং এতে প্রাথমিকভাবে অংশগ্রহণ করবে সৌদি আরবসহ কয়েকটি আরব রাষ্ট্র। এ বাহিনী বিশেষভাবে কাজ করবে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ ও তাৎক্ষণিক জবাব দেওয়ার লক্ষ্যে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক যখন আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, ঠিক তখনই এই পরিকল্পনার খবর প্রকাশ্যে এসেছে। বিভিন্ন আরবি সংবাদমাধ্যম যেমন আল-আখবার, আল-কুদস ও মা’আন নিউজ জানিয়েছে, কাতারে ইসরায়েলি অভিযানের পর নতুন আরব সামরিক জোট নিয়ে আলোচনার গতি বেড়েছে।
ন্যাটো মডেল: অনুপ্রেরণা ও প্রেক্ষাপট
ন্যাটো বা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন হলো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক জোট। ১৯৪৯ সালে গঠিত এই জোট বর্তমানে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও কিছু সহযোগী রাষ্ট্রকে নিয়ে গড়ে উঠেছে। ন্যাটোর মূল শক্তি হলো এর “সমষ্টিগত প্রতিরক্ষা নীতি” (Article 5)। এর আওতায় জোটভুক্ত কোনো দেশ আক্রমণের শিকার হলে সেটিকে সবার ওপর আক্রমণ ধরা হয়।
মিশরের নতুন প্রস্তাবও অনেকটা একই নীতিতে দাঁড়িয়ে আছে। আরব বিশ্বের যেকোনো একটি দেশ হুমকির মুখে পড়লে অন্য দেশগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সেনা পাঠাবে এবং আক্রমণ প্রতিহত করবে।
প্রস্তাবিত আরব সামরিক বাহিনী: কাঠামো ও কার্যপরিধি
১. প্রাথমিক সৈন্যসংখ্যা ও বাহিনী গঠন
মিশরের সামরিক ও কূটনৈতিক সূত্র অনুযায়ী, নতুন জোটের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ২০ হাজার সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে। মিশর সবচেয়ে বড় সংখ্যক সেনা পাঠাবে এবং সৌদি আরবও বড় অবদান রাখবে।
২. সদর দপ্তর ও নেতৃত্ব
কায়রো হবে প্রস্তাবিত বাহিনীর প্রধান সদর দপ্তর। মিশরই এর নেতৃত্ব দেবে। তবে সৌদি আরবসহ ধনী উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করবে।
৩. কার্যপরিধি
- বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ
- সন্ত্রাসবাদ দমন
- সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার
- আঞ্চলিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা
কেন এখন এই উদ্যোগ?
ইসরায়েল-আরব উত্তেজনা
সম্প্রতি কাতারে ইসরায়েলি সামরিক হামলার ঘটনায় পুরো আরব বিশ্বে উত্তেজনা বেড়েছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সমন্বিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হচ্ছিল। এ হামলা সেই প্রক্রিয়াকে আরও গতি দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্য
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও তুরস্ক ক্রমেই প্রভাব বিস্তার করছে। ইরানের সামরিক ক্ষমতা, সিরিয়া ও ইয়েমেনে তার ভূমিকায় সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলো উদ্বিগ্ন। ফলে আরব রাষ্ট্রগুলো এখন একটি যৌথ সামরিক শক্তি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।
অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। তেল ও গ্যাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি আঞ্চলিক সামরিক জোট গঠন তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায়ও সহায়ক হবে।
আগের প্রচেষ্টা ও ব্যর্থতা
যৌথ আরব সামরিক বাহিনী গড়ার আলোচনা নতুন নয়। ২০১৫ সালে সৌদি নেতৃত্বে ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময়ও এমন একটি প্রস্তাব উঠেছিল। তবে রাজনৈতিক মতবিরোধ, দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে পরিকল্পনা সফল হয়নি।
২০১৭ সালেও সৌদি আরব “ইসলামিক মিলিটারি কাউন্টার টেররিজম অ্যালায়েন্স” (IMCTC) নামে একটি জোট ঘোষণা করে। প্রায় ৪১টি দেশ এতে যুক্ত হয়। তবে এটি কার্যকর সামরিক জোটে রূপ নিতে পারেনি।
মিশরের বর্তমান প্রস্তাব সেই আগের ব্যর্থ প্রচেষ্টার নতুন সংস্করণ কিনা, নাকি এটি বাস্তবায়িত হবে—সে বিষয়ে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্র
ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরেই চায় আরব দেশগুলো নিজেদের প্রতিরক্ষা খাতকে আরও সমন্বিত করুক। তবে যুক্তরাষ্ট্র একইসঙ্গে আশঙ্কা করছে, নতুন জোট যদি ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে।
ইসরায়েল
ইসরায়েল এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে দেশটির গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, নতুন আরব সামরিক জোট আসলে “ইসরায়েলের বিরুদ্ধেই” গঠিত হবে। ফলে তারা বিষয়টিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
ইরান
ইরান স্বাভাবিকভাবেই এই উদ্যোগের সমালোচনা করেছে। দেশটির মতে, আরব সামরিক জোট মূলত ইরানের প্রভাব সীমিত করতেই গড়ে তোলা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
- এই জোট কার্যকর হলে আরব বিশ্বে প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়বে।
- তবে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন, স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা এটিকে দুর্বল করে দিতে পারে।
- সৌদি আরব ও মিশর নেতৃত্ব ভাগাভাগি করতে রাজি হবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
প্রস্তাবিত জোট বাস্তবায়িত হলে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি হবে। তবে এর পথে রয়েছে অনেক বাধা:
- রাজনৈতিক মতপার্থক্য – কাতার, সিরিয়া, লেবানন ইত্যাদি দেশগুলোর অবস্থান স্পষ্ট নয়।
- অর্থনৈতিক ভারসাম্য – গরিব আরব দেশগুলো কতটা অর্থনৈতিক সহায়তা পাবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব হতে পারে।
- আন্তর্জাতিক চাপ – যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
মিশরের প্রস্তাবিত ন্যাটো-ধাঁচের আরব সামরিক জোট এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকট, ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা এবং আঞ্চলিক শক্তির দ্বন্দ্ব এই পরিকল্পনাকে সামনে ঠেলে দিয়েছে। বাস্তবে এটি কতদূর বাস্তবায়িত হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই উদ্যোগ নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে আলোড়ন তুলেছে।
MAH – 12819 Signalbd.com