প্রযুক্তি

শনির বলয়ে রংধনুর রহস্য উদ্‌ঘাটন করলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা

Advertisement

শনির বলয়ে রংধনুর রহস্য উদ্‌ঘাটন

গ্রহ শনি সৌরজগতের ষষ্ঠতম গ্রহ। এটি পৃথিবীর চেয়ে বহু গুণ বড় এবং এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো—চারপাশে থাকা বিস্তৃত বলয় বা রিং। শত শত বছর ধরে এই বলয় নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আগ্রহ সীমাহীন। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় শনির বলয়ে দেখা মিলেছে এক আশ্চর্য রংধনুর, যা মহাকাশবিজ্ঞানীদের কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

ডাচ গবেষক নিলস রুব্রেখ্ট ও তাঁর সহকর্মীরা নাসার ক্যাসিনি মহাকাশযান থেকে পাওয়া ছবির বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, এই রহস্যময় আলোকরেখার মূল উৎস হলো শনির উপগ্রহ এনসেলাডাস। এনসেলাডাস একটি বরফে আচ্ছাদিত উপগ্রহ, যেখান থেকে ক্রমাগত বরফকণা মহাকাশে ছিটকে বের হচ্ছে। এই বরফকণাই শনির বলয়ে তৈরি করেছে এক বিস্ময়কর অপটিক্যাল প্রভাব, যা আমাদের পৃথিবীর রংধনুর মতোই।

ক্যাসিনি মিশন: মহাবিস্ময়ের জানালা

২০০৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সক্রিয় থাকা নাসার ক্যাসিনি-হাইগেনস মিশন ছিল সৌরজগতের ইতিহাসে অন্যতম সফল প্রকল্প। প্রায় ১৩ বছর ধরে এটি শনি ও তার উপগ্রহগুলোকে ঘিরে অসংখ্য ছবি, ডেটা ও বৈজ্ঞানিক তথ্য পাঠিয়েছে পৃথিবীতে।

২০১২ সালের ২৭ মার্চ, ক্যাসিনি যখন ১৭তম বার শনির পাশে দিয়ে যায়, তখন এর ভিজুয়াল অ্যান্ড ইনফ্রারেড ম্যাপিং স্পেকট্রোমিটার ও ন্যারো–অ্যাঙ্গেল ক্যামেরায় ধারণ করা ছবিতে দেখা যায়—শনির বলয়ে স্পষ্ট ডোরাকাটা বা “স্ট্রাইপ” আকৃতির আলো।

গবেষকেরা আরও খুঁটিয়ে দেখেন, এই আলোকরেখা কেবল এনসেলাডাসের কাছেই তৈরি হয়েছে। অন্য কোনো উপগ্রহের কাছে এমনটি দেখা যায়নি।

রংধনুর মতো আলো কেন তৈরি হলো?

পৃথিবীতে রংধনু তৈরি হয় বৃষ্টির পানির কণায় সূর্যের আলো প্রতিসরণ ও প্রতিফলনের মাধ্যমে। কিন্তু শনির ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটছে বরফকণার মাধ্যমে।

এনসেলাডাসের বরফ ফোয়ারা থেকে নির্গত অতি ক্ষুদ্র বরফকণা শনির বলয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সূর্যের আলো যখন এসব বরফকণায় আঘাত করে, তখন আলো প্রতিফলিত ও বিচ্ছুরিত হয়। এর ফলে তৈরি হয় অপটিক্যাল প্রভাব, যা দূর থেকে দেখতে রংধনুর মতো লাগে।

সবচেয়ে উজ্জ্বল যে আলোকরেখাটি ধরা পড়েছে, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ৫ মাইক্রোমিটার। বিজ্ঞানীদের মতে, এটি একটি “রিফ্লেকশন গ্রেটিং” এর মতো কাজ করছে, যেখানে বরফকণা আলোর তরঙ্গকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

এনসেলাডাস: এক রহস্যময় উপগ্রহ

এনসেলাডাস সৌরজগতের অন্যতম বিস্ময়কর উপগ্রহ। এর পৃষ্ঠতল বরফে ঢাকা থাকলেও গভীরে রয়েছে তরল পানির মহাসাগর। ২০০৫ সালে ক্যাসিনি প্রথমবার নিশ্চিত করে যে এনসেলাডাস থেকে বরফ ও পানির ফোয়ারা নির্গত হচ্ছে।

গবেষকরা মনে করেন, এই মহাসাগরে জীবনের সম্ভাবনা থাকতে পারে, কারণ সেখানে পানির সঙ্গে রয়েছে হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট ও জৈব যৌগ। অর্থাৎ, পৃথিবীর মতো প্রাণ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ হয়তো সেখানে বিদ্যমান।

শনির বলয়ে রংধনুর মতো আলোর বিচ্ছুরণ প্রমাণ করে যে এনসেলাডাস শুধু বিজ্ঞানীদের কল্পনা নয়, বাস্তবেই একটি সক্রিয় উপগ্রহ, যা পুরো গ্রহীয় পরিবেশে প্রভাব ফেলছে।

কেন আলো কেবল এনসেলাডাসের কাছেই?

প্রশ্ন জাগে—শনির অন্য উপগ্রহ যেমন টাইটান, ডায়ন বা টেথিসেও তো ছবি তোলা হয়েছিল। সেখানে কেন এমন আলো দেখা যায়নি?

বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন, কেবল এনসেলাডাস থেকেই নির্গত হচ্ছে বিশাল পরিমাণ বরফকণা। এই বরফকণাগুলো সদ্য মহাশূন্যে ছিটকে পড়ায় তারা সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ থাকে, ফলে আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ স্পষ্টভাবে হয়।

এছাড়া শনির বলয়ের সমতল থেকে প্রায় ৪৩ ডিগ্রি কোণে এই আলোকরেখা তৈরি হয়েছে। এ কারণে এটি শুধুই ক্যামেরার লেন্সের খেলা নয়, বরং বাস্তব একটি মহাজাগতিক ঘটনা।

পৃথিবীর বাইরের রংধনু

পৃথিবীতে যেমন বৃষ্টির পর আকাশে রংধনু দেখা যায়, সৌরজগতের অন্য জায়গাতেও আলো-সম্পর্কিত কিছু ঘটনা বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন।

  • শুক্র গ্রহে (২০১৪): ভেনাস এক্সপ্রেস অরবিটার শুক্রের মেঘে “সান হালো” নামের আলোর বৃত্ত শনাক্ত করেছিল।
  • মঙ্গল গ্রহে: নাসার পার্সিভিয়ারেন্স রোভার ষড়ভুজাকার বরফকণার কারণে রংধনুর মতো আলো ধরেছিল।
  • পৃথিবীর চাঁদে: কিছু পরিস্থিতিতে সূর্যের আলো ধূলিকণায় প্রতিফলিত হয়ে ক্ষীণ আলোকবৃত্ত তৈরি হয়।

তবে শনির রংধনু আলাদা, কারণ এটি বরফ ফোয়ারা থেকে তৈরি হয়েছে, যা অন্য কোথাও দেখা যায়নি।

গবেষণার গুরুত্ব

এই আবিষ্কার শুধু এক মহাজাগতিক সৌন্দর্যের রহস্য উন্মোচনই নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক তথ্যও দিচ্ছে।

১. এনসেলাডাসের বরফ ফোয়ারা জীবনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করছে।
২. শনির বলয় আসলে কতটা গতিশীল ও জীবন্ত তা প্রকাশ করছে।
৩. আলোকবিজ্ঞানের নতুন দৃষ্টান্ত যোগ করছে, যা ভবিষ্যতে মহাকাশ পর্যবেক্ষণে কাজে আসবে।

ভবিষ্যতের অনুসন্ধান

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা আরও উন্নত মহাকাশযান পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন, যা এনসেলাডাসের মহাসাগর সরাসরি অনুসন্ধান করতে পারবে। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA) ও নাসার যৌথভাবে পরিকল্পিত কিছু প্রকল্পে ইতিমধ্যেই এনসেলাডাসকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

যদি সত্যিই এই বরফময় উপগ্রহে প্রাণের উপাদান পাওয়া যায়, তবে সেটি হবে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক সাফল্য।

শনির বলয়ে রংধনুর মতো আলো কেবল এক চমৎকার দৃশ্যই নয়, বরং মহাকাশবিজ্ঞানকে এক নতুন অধ্যায় দিয়েছে। এনসেলাডাসের বরফকণা প্রমাণ করেছে—গ্রহ ও উপগ্রহের মধ্যে সম্পর্ক শুধু মাধ্যাকর্ষণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আলো ও পদার্থের মিথস্ক্রিয়াতেও লুকিয়ে আছে অসাধারণ রহস্য।

এই আবিষ্কার আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মহাবিশ্ব অসীম রহস্যে ভরপুর। হয়তো খুব শিগগিরই আরও নতুন “রংধনু” আবিষ্কার আমাদের মহাবিশ্বকে আরও কাছ থেকে জানার সুযোগ করে দেবে।

MAH – 12790,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button