একাতারে ইসরাইলের হামলা: জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের তীব্র নিন্দা

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ইসরাইলের আগ্রাসী সামরিক কর্মকাণ্ডের কারণে। এবার ইসরাইল বিমান হামলা চালিয়েছে কাতারের রাজধানী দোহায়। এই হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ছয়জন নিরীহ বেসামরিক মানুষ। এ ঘটনার পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসে এবং সর্বসম্মতভাবে ইসরাইলি আগ্রাসনের নিন্দা জানায়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, ইসরাইলের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও এই নিন্দা প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে।
এই সংবাদটি শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কেননা কাতার দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি ইস্যুতে অন্যতম মধ্যস্থতাকারী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। দেশটি হামাসসহ অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফলে কাতারের উপর হামলা শুধু আঞ্চলিক রাজনীতির জন্য নয়, বৈশ্বিক শান্তি প্রচেষ্টার জন্যও একটি বড় ধাক্কা।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক
বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠক আহ্বান করে। বৈঠকে ১৫ সদস্য রাষ্ট্র সর্বসম্মতভাবে একটি যৌথ বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে কাতারের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা প্রশমনের আহ্বান জানানো হয়।
যদিও বিবৃতিতে সরাসরি “ইসরাইল” শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি, তবে এর ভেতরের বার্তা ছিল স্পষ্ট। দেশগুলো বলেছে, “যুদ্ধবিরতি অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে, গাজায় নিরীহ মানুষের ওপর হামলা বন্ধ করতে হবে এবং জিম্মি মুক্তির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরাইলের নাম উল্লেখ না করার কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা। তবে তবুও, এই সর্বসম্মত নিন্দা বিশ্ব কূটনীতিতে একটি বড় বার্তা।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো—যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের সব কর্মকাণ্ডের পক্ষে দাঁড়ানো আমেরিকা এবার কাতারে হামলার নিন্দায় সায় দিয়েছে।
এটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন মোড় আনতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজার চলমান যুদ্ধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের উপর চাপ বাড়ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ, এমনকি লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোও ইসরাইলবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
কাতারের ভূমিকা ও গুরুত্ব
কাতার বহু বছর ধরে ফিলিস্তিন ইস্যুতে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষ করে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় কাতার একাধিকবার মধ্যস্থতা করেছে।
এছাড়া কাতার গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে অন্যতম প্রধান অর্থদাতা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে কাতার বহু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ফলে দোহায় হামলা মানে শুধু একটি রাষ্ট্রের ওপর হামলা নয়, বরং ফিলিস্তিনি ইস্যুতে বৈশ্বিক মানবিক প্রচেষ্টার উপরও আঘাত।
দোহায় বিমান হামলা: কী ঘটেছিল?
গত মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাতে দোহায় একাধিক বিমান হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শহরের আবাসিক এলাকায় আকস্মিকভাবে মিসাইল আঘাত হানে। এতে ছয়জন নিহত হন, যাদের মধ্যে দুইজন শিশু ও একজন নারী ছিলেন।
হামলার সময় বেশ কয়েকটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং আহত হন অন্তত ১৫ জন। স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
কাতার সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, “এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পরপরই বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে।
- তুরস্ক বলেছে, “ইসরাইলের এই হামলা প্রমাণ করে, তারা কোনো নিয়মকানুন মানতে চায় না। মুসলিম বিশ্বের ঐক্যই এখন জরুরি।”
- ইরান সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, “কাতারের ওপর হামলা মানে পুরো মুসলিম বিশ্বের ওপর হামলা।”
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং অবিলম্বে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় ফেরার আহ্বান জানিয়েছে।
- মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, “কাতারের নিরীহ মানুষদের ওপর এই হামলা যুদ্ধাপরাধের শামিল।”
ফিলিস্তিনের প্রতিক্রিয়া
গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা কাতারের প্রতি সংহতি জানিয়েছে। তারা বলছে, কাতার সবসময় ফিলিস্তিনিদের পাশে থেকেছে। ফলে দোহায় হামলা মানে ফিলিস্তিনি আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা।
হামাসের এক মুখপাত্র বলেছেন, “ইসরাইলের উদ্দেশ্য হলো কাতারকে ভয় দেখানো, যাতে তারা মধ্যস্থতা থেকে সরে দাঁড়ায়। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, কাতার তার অবস্থান ধরে রাখবে।”
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি
মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইল, ইরান, তুরস্ক, কাতার ও সৌদি আরবের মধ্যে জটিল ক্ষমতার ভারসাম্য রয়েছে। কাতার সাধারণত নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখলেও ফিলিস্তিন ইস্যুতে সবসময় স্পষ্টভাষী।
ইসরাইলের এই হামলা মূলত কাতারকে চাপের মুখে ফেলার একটি কৌশল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে এর ফলে ইসরাইল আরও বেশি আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতায় পড়তে পারে।
মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের বহু রাষ্ট্র ইসরাইলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেছেন, “আমরা কাতারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত ইসরাইলকে অবিলম্বে থামানো।”
শান্তি প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত নিন্দা আন্তর্জাতিক শান্তি প্রচেষ্টায় নতুন আশা জাগিয়েছে। যদিও ইসরাইলের নাম সরাসরি উল্লেখ না করায় সমালোচনা রয়েছে, তবুও এটাই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে সর্বসম্মত একটি অবস্থান তৈরি হলো।
কূটনীতিকরা বলছেন, যদি এই চাপ বজায় থাকে তবে ভবিষ্যতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। যেমন—অস্ত্র সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক অবরোধ, কিংবা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা।
কাতারের দোহায় ইসরাইলি বিমান হামলা শুধু একটি স্থানীয় ঘটনা নয়; এটি বৈশ্বিক রাজনীতির একটি বড় মোড়। এই হামলা প্রমাণ করেছে, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা যেকোনো সময় বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিতে পারে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত নিন্দা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত বিশ্ব রাজনীতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো—এই হামলার পর বিশ্বজুড়ে মানুষ শান্তির দাবি আরও জোরালোভাবে তুলছে। এখন দেখার বিষয়, ইসরাইল এই চাপের মুখে নীতি পরিবর্তন করে কিনা, নাকি আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে।
MAH – 12769, Signalbd.com