বাংলাদেশ

জাকসুতে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থীর অভিযোগ, জামায়াতের প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা ব্যালটে নির্বাচন!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন দীর্ঘ সময় পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে এ নির্বাচনে শুরু থেকেই নানা বিতর্ক, অভিযোগ আর প্রশ্ন উঠেছে। সর্বশেষ অভিযোগ এসেছে যে, ভোটগ্রহণে ব্যবহৃত ব্যালট পেপার জামায়াতে ইসলামী ঘনিষ্ঠ একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কেনা হয়েছে।

ছাত্রদল সমর্থিত সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী মো. শেখ সাদী হাসান সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ তুলে ধরেন। তার দাবি, এভাবে ব্যালট কেনা মূলত ছাত্রশিবিরকে বিজয়ী করার একটি পরিকল্পিত নীলনকশার অংশ।

ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থীর অভিযোগ

বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ সাদী বলেন,
“ভোটের আগের রাতেই আমরা সামাজিক মাধ্যমে জানতে পারি যে, প্রশাসন যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ব্যালট ও ওএমআর মেশিন কিনেছে। এ প্রতিষ্ঠান জামায়াতে ইসলামী ঘনিষ্ঠ। উদ্দেশ্য ছিল ভোটগণনায় কারচুপি করা।”

তিনি আরও বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে প্রশাসন শেষ পর্যন্ত ওএমআর মেশিনে ভোট গণনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, কেন এমন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ব্যালট সংগ্রহ করা হলো?

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

অভিযোগ উঠেছে, নির্বাচন কমিশন শুরু থেকেই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থীরা বলছেন, কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

শেখ সাদী সংবাদ সম্মেলনে আরও যোগ করেন—
“এখন যেভাবে একই প্রতিষ্ঠানের ব্যালটে ভোট গ্রহণ করা হচ্ছে, তাতে আমরা আশঙ্কা করছি নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে। আমরা দাবি জানাই, নতুন ব্যালটে ভোট আয়োজন করতে হবে। নতুবা ফলাফল নিয়ে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে।”

জাকসু নির্বাচনের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে জাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর মতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসুও ছাত্ররাজনীতির অন্যতম বড় প্ল্যাটফর্ম। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক পর জাকসু নির্বাচন হচ্ছে।

  • সর্বশেষ জাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯২ সালে।
  • দীর্ঘদিন পর এ নির্বাচন হওয়ায় শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ছিল ভিন্নধর্মী ও সুষ্ঠু ভোট।
  • কিন্তু শুরু থেকেই একের পর এক অভিযোগ উঠছে—ব্যালট প্রস্তুতি থেকে শুরু করে প্রার্থীর পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, ভীতি প্রদর্শন, প্রশাসনের পক্ষপাত ইত্যাদি।

জামায়াত-শিবির প্রসঙ্গ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে জামায়াত-শিবিরের প্রভাব নিয়ে আলোচনায় থাকে। বিশেষ করে ২০০০ সালের পর থেকে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে শিবির প্রায়শই সক্রিয় ছিল।

  • একাধিকবার সহিংসতার জন্য শিবিরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
  • সরকারিভাবে ক্যাম্পাসে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকলেও ছদ্মবেশে সক্রিয় থাকার অভিযোগ আছে।
  • এবার ব্যালট পেপার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের যোগসূত্র বেরিয়ে আসায় বিতর্ক আরও বেড়েছে।

শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া

ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “যে প্রতিষ্ঠান অতীতে জামায়াত-শিবিরকে সহায়তা করেছে, সেই প্রতিষ্ঠান থেকে কেন ব্যালট কিনতে হলো?”

একজন শিক্ষার্থী বলেন,
“আমরা চাই একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন। কিন্তু এভাবে বিতর্কিত কোম্পানি থেকে ব্যালট আনা মানে নির্বাচনকে বিতর্কিত করে তোলা।”

অন্যদিকে, কিছু শিক্ষার্থী মনে করছেন, বিরোধী পক্ষ ইস্যুটি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে। তাদের মতে, অভিযোগ সত্য হলেও ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে সমস্যা নেই।

নির্বাচন কমিশনের অবস্থান

অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ব্যালট পেপার সংগ্রহ করা হয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম নেই।”

তবে ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থীরা বলছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়া গোপনে সম্পন্ন হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ব্যালট কিনেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

রাজনীতি ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাকসু নির্বাচন ঘিরে এতদিনে যে আশা তৈরি হয়েছিল, তা ভেস্তে যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন,
“যেকোনো নির্বাচনেই ব্যালট ও সরঞ্জাম সংগ্রহ একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। এ নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, তাহলে পুরো নির্বাচনের বৈধতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।”

রাজনৈতিক প্রভাব

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি মূল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিফলন। তাই জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, বামধারা ও ছাত্রশিবির—সবার অংশগ্রহণ আছে।

  • ছাত্রলীগ চায় প্রশাসনের সহায়তায় জয়ী হতে।
  • ছাত্রদল দাবি করছে, শিবিরকে জেতাতে প্রশাসন পরিকল্পনা করছে।
  • বামধারা বলছে, উভয় বড় দলের কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হচ্ছে।

ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসু নির্বাচন দীর্ঘদিন পর হলেও শুরু থেকেই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। জামায়াত ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ব্যালট সংগ্রহের অভিযোগে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে।

এখন সবার নজর নির্বাচন কমিশনের ওপর। তারা যদি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে শিক্ষার্থীদের আস্থার সংকট আরও গভীর হবে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button