বিশ্ব

নাইজেরিয়ায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা: বোর্নো রাজ্যে নিহত ৬৩ জন

Advertisement

নাইজেরিয়ার উত্তর–পূর্বাঞ্চলের বোর্নো রাজ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠীর বর্বরোচিত হামলায় অন্তত ৬৩ জন নিহত হয়েছেন। শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে আটটার দিকে বোর্নোর দারুল জামাল শহরে এই হামলার ঘটনা ঘটে। এ এলাকা নাইজেরিয়া-ক্যামেরুন সীমান্তের কাছে অবস্থিত এবং সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে বেসামরিক নাগরিক ছাড়াও অন্তত ৫ জন সেনাসদস্য রয়েছেন। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

হামলার বিবরণ

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, রাতের অন্ধকারে মোটরসাইকেলে করে ডজনখানেক সশস্ত্র ব্যক্তি গ্রামে প্রবেশ করে। তাদের হাতে ছিল স্বয়ংক্রিয় রাইফেল এবং গুলি চালানোর পাশাপাশি তারা গ্রামবাসীর বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আতঙ্কিত গ্রামবাসীরা প্রাণ বাঁচাতে বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যায়।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী মালাম বুকার বলেন:

“তারা চিৎকার করতে করতে হামলা চালায়। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে। আমরা পরিবার নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে জঙ্গলে পালিয়ে যাই। সকালে ফিরে এসে দেখি—পুরো গ্রাম ধ্বংস, চারদিকে লাশ।”

পুনর্বাসন নীতিতে প্রশ্নবিদ্ধতা

গত কয়েক বছর ধরে নাইজেরিয়া সরকার অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষদের আশ্রয়শিবির থেকে সরিয়ে নিজ গ্রামে পুনর্বাসন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক এই হত্যাযজ্ঞ সেই উদ্যোগকে বড় ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বোর্নো রাজ্যের গভর্নর বাবাগানা জুলুম সাংবাদিকদের বলেন:

“এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। কয়েক মাস আগে এই মানুষগুলোকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিল। কিন্তু আজ আমরা ৬৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছি।”

হামলার পেছনের কারণ ও জঙ্গিগোষ্ঠী

নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র সহিংসতার শিকার। বোকো হারাম নামের উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ২০০৯ সাল থেকে এ অঞ্চলে তাণ্ডব চালিয়ে আসছে। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বোকো হারামের হামলায় হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। পরে বোকো হারামের দুর্বলতার সুযোগে উঠে আসে আরেক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসডব্লিউএপি (Islamic State West Africa Province)

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বোকো হারাম ও আইএসডব্লিউএপি নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তারা সাধারণ জনগণ ও সরকারি বাহিনীকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো অব্যাহত রেখেছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

নিরাপত্তা সংকট ও সরকারের চ্যালেঞ্জ

নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদারের চেষ্টা করছে। তবে অপর্যাপ্ত জনবল, ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা এবং সীমান্তবর্তী জঙ্গিদের ঘাঁটি নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

গভর্নর জুলুম বলেন:

“আমাদের সেনাবাহিনী সাহসিকতার সঙ্গে লড়ছে, কিন্তু জনবল পর্যাপ্ত নয়। তাই ফরেস্ট গার্ডস নামে একটি নতুন বাহিনী গঠন করে এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হবে।”

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই হামলা প্রমাণ করে—জঙ্গিগোষ্ঠী এখনো শক্তিশালী এবং কৌশলী। তারা নাইজেরিয়া-ক্যামেরুন সীমান্তের বনাঞ্চল ব্যবহার করে দ্রুত হামলা চালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয়দের মানবিক সংকট

এই হত্যাযজ্ঞের পর গ্রামবাসী মারাত্মক সংকটে পড়েছে। অনেকে এখনো নিখোঁজ। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন জানিয়েছে, শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে এবং তারা আশ্রয়ের জন্য নিকটবর্তী শহরে গিয়েছে।

একজন নারী বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী বলেন:

“আমার স্বামীকে তারা গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি দুই সন্তানকে নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালিয়েছি। আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ ও আফ্রিকান ইউনিয়ন এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং নাইজেরিয়া সরকারকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, শুধু নিন্দা জানালেই হবে না, জঙ্গিবাদ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ ও দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা কৌশল প্রয়োজন

নাইজেরিয়ার সন্ত্রাসী হামলার পেছনের বাস্তবতা

  1. দারিদ্র্য ও বেকারত্ব: নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দারিদ্র্য ব্যাপক, যা জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্য সহজ নিয়োগের সুযোগ তৈরি করে।
  2. ধর্মীয় উগ্রবাদ: বোকো হারাম ও আইএসডব্লিউএপি ধর্মের অপব্যাখ্যা ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করছে।
  3. দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা: সীমান্তবর্তী এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি কম, ফলে জঙ্গিদের জন্য সহজ লক্ষ্যবস্তু।
  4. আন্তর্জাতিক তহবিল ও সমর্থন: আইএসডব্লিউএপি মাঝে মাঝে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আর্থিক সহায়তা পায় বলে ধারণা করা হয়।

নাইজেরিয়ার সরকার ও জনগণের করণীয়

  • নিরাপত্তা জোরদার: সেনাবাহিনী ও নতুন গঠিত বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি সরবরাহ করতে হবে।
  • অর্থনৈতিক উন্নয়ন: কর্মসংস্থান ও শিক্ষা বাড়ানো ছাড়া জঙ্গিবাদ রোধ করা সম্ভব নয়।
  • আঞ্চলিক সহযোগিতা: ক্যামেরুন, নাইজার ও চাদের সঙ্গে যৌথ অভিযান জোরদার করতে হবে।
  • জঙ্গিদের পুনর্বাসন: যারা অস্ত্র ছেড়ে সমাজে ফিরতে চায়, তাদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করা জরুরি।

MAH – 12668,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button