
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামিরের মধ্যে তীব্র বিরোধ দেখা দিয়েছে। গাজা সিটি দখল এবং চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উভয়ের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। প্রায় ছয় ঘণ্টার টানা আলোচনায় নেতানিয়াহুর দ্রুত সামরিক পদক্ষেপের পরিকল্পনার বিপরীতে জামির সতর্ক করেন জিম্মিদের জীবনের ঝুঁকি ও সেনাদের উপর অতিরিক্ত চাপের বিষয়ে।
গাজা সিটি অভিযান নিয়ে দ্বন্দ্ব
মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে জানান, তিনি গাজা সিটিতে দ্রুততম সময়ে পূর্ণাঙ্গ অভিযান চালাতে চান। তবে সেনাপ্রধান জামির এর বিরোধিতা করে বলেন, এতে আইডিএফ (ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে এবং বর্তমানে হামাসের হাতে থাকা অন্তত ৪৮ জন জিম্মির জীবন হুমকির মুখে পড়বে।
জামিরের মতে, সামরিক অভিযান আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করবে এবং যুদ্ধবিরতির আলোচনার পথ বন্ধ করে দেবে। অন্যদিকে নেতানিয়াহু মনে করেন, আংশিক চুক্তি কিংবা সীমিত পদক্ষেপে ইসরাইলের নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে না।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে মতবিরোধ
বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী, অন্তত ১০ জন জীবিত জিম্মি এবং ১৮ জন নিহত বন্দির মরদেহ ফেরত দেওয়ার বিনিময়ে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। জামির মনে করেন, এটি দীর্ঘমেয়াদে হামাসকে চাপে রাখার জন্য কার্যকর কৌশল হতে পারে। কিন্তু নেতানিয়াহু আংশিক মুক্তির এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পূর্ণাঙ্গ বিজয়ের লক্ষ্যে অবিচল থাকার ঘোষণা দেন।
অতীত নির্দেশনা ও সামরিক সতর্কতা
এর আগে আগস্ট মাসে নেতানিয়াহু গাজা সিটি দখলের অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে সেনাপ্রধান জামির তখনও সতর্ক করে জানিয়েছিলেন, মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালাতে অন্তত দুই মাস সময় প্রয়োজন এবং হঠাৎ অভিযান জিম্মিদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
এই সতর্কতা উপেক্ষা করে সরকারের একাংশ গাজায় দ্রুত অভিযান শুরু করার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়, যা মন্ত্রিসভার ভেতরে গভীর বিভাজন সৃষ্টি করেছে।
সেনাদের অসন্তুষ্টি ও জনমত
সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, ইসরাইলি রিজার্ভ সেনাদের বড় একটি অংশ সরকারের পরিকল্পনায় অসন্তুষ্ট। তাদের অভিযোগ, গাজা যুদ্ধ-পরবর্তী কোনো স্পষ্ট কৌশল নেই এবং বিজয়ের জন্য সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়নি।
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রিজার্ভ সেনা গণমাধ্যমকে বলেন, “আমরা এমন কিছু করছি না যা হামাসকে জিম্মি মুক্ত করতে কার্যকর চাপ দিচ্ছে।”
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া
গাজায় দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ, বেসামরিক মানুষের মৃত্যু এবং মানবিক সংকট আন্তর্জাতিক মহলে ইসরাইলের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো প্রকাশ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে সমর্থন জানালেও নেতানিয়াহু নিজের অবস্থান পরিবর্তন করছেন না।
বিশ্লেষকদের মতে, নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক টিকে থাকার জন্য কঠোর সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের চাপ রয়েছে, অন্যদিকে সেনাপ্রধান জামিরের মূল উদ্বেগ হলো জিম্মিদের জীবন রক্ষা এবং সেনাদের নিরাপত্তা।
ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
বর্তমান পরিস্থিতি ইসরাইলি নেতৃত্বের মধ্যে গভীর দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত দেয়। মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরে এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামরিক অভিযান ও কূটনৈতিক আলোচনার ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি সরকার সামরিক অভিযানে জোর দেয়, তবে জিম্মিদের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে এবং আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়বে। অন্যদিকে, যদি যুদ্ধবিরতির পথে হাঁটে, তবে রাজনৈতিকভাবে নেতানিয়াহুর অবস্থান দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
পরিশেষে
গাজা সিটির অভিযানে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত ইসরাইলি রাজনীতির জন্য একটি বড় মোড়। একদিকে সেনাপ্রধানের সতর্কবার্তা, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর দৃঢ় অবস্থান—দুই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ইসরাইলি সমাজে অনিশ্চয়তা ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। শেষ পর্যন্ত সরকার কোন পথে এগোয়, তা নির্ধারণ করবে শুধু জিম্মিদের ভাগ্যই নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির ভবিষ্যৎও।
এম আর এম – ১১৪৯, Signalbd.com