ট্রাম্পের ৫০% শুল্কে বিপাকে ভারতীয় রপ্তানি খাত

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতি এবং ভারতের সংকট
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হওয়া ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে ২৭ আগস্ট ২০২৫ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারদের মধ্যে ভারত অন্যতম। ফলে এই শুল্ক আরোপ ভারতের অর্থনীতি, রপ্তানি খাত ও লাখো শ্রমিকের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শুল্ক কার্যত ভারতীয় পণ্যের ওপর এক ধরনের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা হিসেবে কাজ করবে। শুধু পোশাক শিল্প নয়, চিংড়ি, হীরা, গয়না ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতেও ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।
কেন ট্রাম্প শুল্ক বাড়ালেন?
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার মতে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অতি-নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, এবং মার্কিন শিল্পের জন্য তা হুমকি তৈরি করছে। এছাড়া ভারত রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র কেনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ছিল। এর জের ধরেই ৫০ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনে আরও ২৫ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্ক যোগ হয়েছে।
ভারতের রপ্তানি খাতের চিত্র: বড় ঝুঁকিতে পোশাক শিল্প
ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ টেক্সটাইল রপ্তানিকারক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানির বড় অংশ আসে ভারতের তামিলনাডুর তিরুপ্পুর থেকে। এই শহরটিকে বলা হয় “ভারতের তৈরি পোশাকের রাজধানী”। কিন্তু বর্তমানে এই শহরে হাজারো সেলাই মেশিন নীরব।
তিরুপ্পুর থেকে ওয়ালমার্ট, টার্গেট, গ্যাপ ও জারার মতো ব্র্যান্ডে বছরে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, যা ভারতের মোট রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ। এই খাতেই এখন অর্ডার কমে যাওয়ায় ছাঁটাই শুরু হয়েছে।
কারখানা মালিক এন কৃষ্ণমূর্তি বলেন,
“সেপ্টেম্বরের পর থেকে করার মতো কিছুই থাকবে না। ইতিমধ্যে আমাদের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে। নতুন নিয়োগ দেওয়া ২৫০ শ্রমিককে বসিয়ে রাখতে হয়েছে।”
শুল্কের কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ভারত
৫০ শতাংশ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের পণ্য অস্বাভাবিকভাবে দামি হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ,
- যুক্তরাষ্ট্রে ১০ ডলারের ভারতীয় শার্টের দাম হবে ১৬.৪ ডলার
- চীন থেকে একই পণ্য পাওয়া যাবে ১৪.২ ডলারে
- বাংলাদেশ থেকে ১৩.২ ডলারে
- ভিয়েতনাম থেকে ১২ ডলারে
এমনকি যদি শুল্ক ২৫ শতাংশে নামানো হয়, তবুও ভারত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকবে।
চিংড়ি খাতে ভয়াবহ প্রভাব
ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশ, এবং যুক্তরাষ্ট্র এর প্রধান বাজার। নতুন শুল্কের কারণে এই খাতে মোট শুল্ক দাঁড়াবে ৬০ শতাংশের বেশি।
অন্ধ্রপ্রদেশের রপ্তানিকারক ঠোটা জগদীশ বলেন,
“এটা আমাদের মৌসুম। বড়দিন ও নববর্ষের জন্য মার্কিন ক্রেতারা এখন অর্ডার দিত। কিন্তু শুল্কের কারণে সব অনিশ্চিত হয়ে গেছে।”
এই পরিস্থিতিতে হ্যাচারিগুলো উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। আগে যেখানে বছরে ১০ কোটি লার্ভা উৎপাদন হতো, এখন তা কমে ৬-৭ কোটিতে নেমে এসেছে। এর ফলে সরাসরি ৫ লাখ এবং পরোক্ষভাবে ২৫ লাখ মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে।
হীরার বাজারে ধাক্কা
গুজরাটের সুরাট শহর হীরা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য বিশ্বখ্যাত। ভারতের ১০ বিলিয়ন ডলারের রত্ন ও গয়না রপ্তানির বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্রে যায়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ৩-৪ বিলিয়ন ডলারের গয়না রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুল্কের কারণে অর্ডার কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ক্রিয়েশন জুয়েলারির মালিক আদিল কোটওয়াল বলেন,
“আমাদের লাভের হার মাত্র ৩-৪ শতাংশ। ১০ শতাংশ শুল্কও বহন করা কঠিন। ৫০ শতাংশ হলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।”
শ্রমিকদের সংকট: আয় কমছে, ছাঁটাই বাড়ছে
ভারতের পোশাক, গয়না, চিংড়ি শিল্পে লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন সংকটে। সুরাটের হীরা শিল্পে আগে মাসে ৩০০০ শ্রমিক কাজ করত, এখন তা কমে মাত্র ৭০ জন। অনেককে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ভবেশ ট্যাঙ্ক বলেন,
“শ্রমিকদের আয় কমছে, অনিচ্ছাকৃত ছুটি বাড়ছে, মাসিক বেতন ক্রমেই কমছে।”
ভারত সরকারের করণীয়: বিকল্প বাজার ও আত্মনির্ভরতা
ভারত সরকার কাঁচামালের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার, নতুন বাণিজ্য চুক্তি এবং বিকল্প বাজার খোঁজা শুরু করেছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পদক্ষেপগুলো অনেক দেরিতে এসেছে।
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অজয় শ্রীবাস্তব বলেন,
“আমরা বাণিজ্য মোড় ঘুরতে দেখব। মার্কিন ক্রেতারা চলে যাবে মেক্সিকো, ভিয়েতনাম কিংবা বাংলাদেশে।”
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোথায় দাঁড়িয়ে?
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দিল্লিতে নির্ধারিত বাণিজ্য বৈঠক বাতিল হয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা ভারতকে “চীনের ঘনিষ্ঠ” ও “রাশিয়ার মানি লন্ডারিংয়ের কেন্দ্র” বলে কটাক্ষ করেছেন।
এশিয়া গ্রুপ অ্যাডভাইজরির গোপাল নাদ্দুর বলেন,
“ভারতের জন্য এখন একটাই মন্ত্র— আত্মনির্ভর হও, বাজার বৈচিত্র্য করো এবং কোনো সুযোগ হাতছাড়া করো না।”
MAH – 12494 , Signalbd.com