বাংলাদেশ ব্যাংকে সুকুক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ শরিয়াহ প্রস্তাবনা প্রদান

প্রস্তাবনা
বাংলাদেশে ইসলামি অর্থনীতির প্রসার ও শরিয়াহসম্মত বিনিয়োগ পদ্ধতির উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ইসলামি অর্থনীতি বিষয়ক শীর্ষস্থানীয় গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান মারকাযু দিরাসাতিল ইকতিসাদিল ইসলামী (CIES) বাংলাদেশ ব্যাংকে সুকুক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ শরিয়াহ প্রস্তাবনা প্রদান করেছে। এই প্রস্তাবনা দেশের অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাত ও বিনিয়োগ ব্যবস্থার জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
রোববার (২৪ আগস্ট ২০২৫) রাজধানীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর ইস্তেকমাল হোসেনের হাতে গবেষণাপত্রটি তুলে দেন সিআইইএসের পক্ষ থেকে মুফতী আহসানুল ইসলাম ও মুফতী সানাউল্লাহ।
এই গবেষণাপত্রে সরকারি সুকুকের শরিয়াহ, গভর্নেন্স, কাঠামোগত উন্নয়ন এবং বাস্তবায়ন কৌশল নিয়ে বিস্তারিত সুপারিশ করা হয়েছে।
সুকুক কী? কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
সুকুক হলো শরিয়াহসম্মত বন্ড, যা ইসলামী আর্থিক নীতিমালা অনুযায়ী তৈরি। এটি সুদমুক্তভাবে অর্থ সংগ্রহ ও বিনিয়োগের বৈধ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়।
- সুদবিহীন অর্থায়ন: প্রচলিত বন্ডে সুদ থাকে, যা ইসলামি শরিয়াহর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সুকুকের ক্ষেত্রে সুদের পরিবর্তে প্রকৃত সম্পদে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে আয় হয়।
- অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়ক: সড়ক, সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাউজিংসহ বৃহৎ প্রকল্পে বিনিয়োগে সুকুক কার্যকর ভূমিকা রাখে।
- আর্থিক স্থিতিশীলতা: সুকুক ইস্যুর মাধ্যমে সরকারের অর্থ সংগ্রহের নতুন পথ তৈরি হয়, যা অর্থনৈতিক খাতে বৈচিত্র্য ও স্থিতিশীলতা আনে।
বিশ্বের অনেক দেশ যেমন মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া দীর্ঘদিন ধরে সুকুক ব্যবহার করছে। বর্তমানে বৈশ্বিক সুকুক বাজারের আকার ৭০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। বাংলাদেশও এই বাজারে প্রবেশ করলে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ও উদ্যোগ
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে শরিয়াহসম্মত আর্থিক পণ্য উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি সুকুক ইস্যু শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে। তবে এই প্রক্রিয়াকে আরও গভর্নেন্স, স্বচ্ছতা ও শরিয়াহ অনুবর্তিতা নিশ্চিত করতে নতুন গবেষণাভিত্তিক প্রস্তাবনার প্রয়োজন ছিল।
সিআইইএসের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে:
- গভর্নেন্স মডেল তৈরি করা হবে।
- শরিয়াহ বোর্ডের ভূমিকা আরও শক্তিশালী হবে।
- প্রকল্পভিত্তিক সুকুক ইস্যুর পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
- সুকুক মার্কেটের জন্য সেকেন্ডারি মার্কেট তৈরি করা হবে।
গবেষণাপত্রের মূল সুপারিশসমূহ
সিআইইএস প্রদত্ত প্রস্তাবনায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে:
সুকুক স্ট্রাকচার: ইজারা (ভাড়া), মুশারাকা (অংশীদারিত্ব), মুরাবাহা (ক্রয়-বিক্রয়) ভিত্তিক সুকুক ইস্যু করা।
প্রকল্পভিত্তিক বিনিয়োগ: যেমন সড়ক, সেতু, হাউজিং, শক্তি খাত।
সেকেন্ডারি মার্কেট গঠন: সুকুক কেনা-বেচার জন্য একটি বাজার তৈরি করতে হবে।
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা: বাংলাদেশ ব্যাংক ও শরিয়াহ বোর্ডের সম্মিলিত তত্ত্বাবধান।
সচেতনতা বৃদ্ধি: বিনিয়োগকারী ও ব্যাংকারদের জন্য প্রশিক্ষণ, কর্মশালা আয়োজন।
সুকুকের সম্ভাবনা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে
বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশমান। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মেগা প্রকল্প, জ্বালানি খাতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। বর্তমানে সরকার বৈদেশিক ঋণ ও প্রচলিত বন্ডের ওপর নির্ভরশীল। সুকুক চালু হলে:
- বড় বিনিয়োগ প্রকল্পের জন্য বিকল্প অর্থায়ন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
- সুদমুক্ত আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বাড়বে।
- প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
- বাজারে তারল্য বৃদ্ধি পাবে।
বিশ্বের সুকুক বাজার ও বাংলাদেশ
মালয়েশিয়া: বৈশ্বিক সুকুক ইস্যুর অর্ধেকের বেশি মালয়েশিয়ায় হয়।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত: তেলভিত্তিক অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে সুকুকের মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছে।
ইন্দোনেশিয়া: সরকারি প্রকল্পের অর্থায়নে সুকুক সফলভাবে ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশ যদি সঠিকভাবে সুকুক মার্কেট গড়ে তুলতে পারে, তাহলে দেশটি এশিয়ার সুকুক মার্কেটে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
যদিও সুকুকের সম্ভাবনা অনেক, তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:
- আইনি কাঠামোর জটিলতা
- সুকুক স্ট্রাকচারের অভিজ্ঞতার ঘাটতি
- বিনিয়োগকারীদের সচেতনতার অভাব
সমাধান হিসেবে:
আইনি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো শক্তিশালী করা
শরিয়াহ বোর্ডকে স্বাধীন ও দক্ষ রাখা
প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিরেক্টর ইস্তেকমাল হোসেন জানান,
“সুকুক বাজার উন্নয়নে এই ধরনের গবেষণা ও প্রস্তাবনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করব এবং বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।”
উপস্থিত অতিথিরা
প্রস্তাবনা হস্তান্তরের সময় উপস্থিত ছিলেন:
- ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা
- আইএফএ’র সিনিয়র কনসালটেন্ট মেজবাহ উদ্দিন
- সিআইইএসের শীর্ষ গবেষক ও মুফতিগণ
বাংলাদেশে সুকুক বাজার গড়ে উঠলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত হবে। শরিয়াহসম্মত এই আর্থিক পদ্ধতি ইসলামী অর্থনীতি ও প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করবে। ফলে বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
MAH – 12480 , Signalbd.com