
বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এই সংস্থার মূল দায়িত্ব হলো দেশের আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা রক্ষা করা, অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ করা এবং সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করে আইনগত পদক্ষেপে সহায়তা করা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সংস্থাটির প্রধান এএফএম শাহীনুল ইসলামকে নিয়ে একের পর এক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একাধিক ভিডিও এবং অনিয়মের অভিযোগের কারণে তাঁকে অবশেষে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তিগত ইস্যু নয়; বরং দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে প্রশ্ন তুলেছে। কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হলো, কী অভিযোগ উঠেছে, কীভাবে তদন্ত চলছে এবং এর প্রভাব কী হতে পারে—এসব বিষয় নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
কী ঘটেছে?
২০২৫ সালের আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ ওঠে, ভিডিওগুলোর কিছু অংশে দেখা যায় শাহীনুল ইসলামকে এমন কিছু কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে, যা একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার জন্য মর্যাদাহানিকর ও বিতর্কিত। এ ঘটনাই প্রথমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে ও বাইরে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, এই ভিডিওগুলো শুধু ব্যক্তিগত নয়; বরং পুরো প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে।
কর্মচারীদের অবস্থান
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অংশ গত ১৯ আগস্ট গভর্নরের কাছে একটি স্মারকলিপি জমা দেন। এতে দাবি করা হয়—
- শাহীনুল ইসলামের ভিডিও কেলেঙ্কারি দেশের আর্থিক খাতের ভাবমূর্তিকে বিপজ্জনকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
- তিনি দায়িত্বে থেকে প্রভাব খাটিয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
- বিশেষভাবে অভিযোগ করা হয়, এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর স্থগিত হওয়া একটি ব্যাংক হিসাব থেকে অবৈধভাবে প্রায় ১৯ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমতি দেন তিনি।
এই অভিযোগগুলোকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়।
তদন্ত কমিটি গঠন
পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেয়।
- একজন ডেপুটি গভর্নর
- দুজন নির্বাহী পরিচালক
নিয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তাদের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগও সহায়তা করছে। প্রাথমিকভাবে কমিটি তদন্ত করছে ভিডিওর সত্যতা ও আর্থিক অনিয়মের বিষয়গুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের জানান, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে তদন্ত শুরু হয়েছে। ফলাফলের ভিত্তিতেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অতীত ইতিহাস: বিএফআইইউতে নেতৃত্ব সংকট
এটি প্রথম নয় যে বিএফআইইউর নেতৃত্বে বিতর্ক তৈরি হলো।
- ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তৎকালীন প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাসকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে হয়।
- দীর্ঘদিন পদ খালি থাকার পর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে শাহীনুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
অবাক করার বিষয় হলো, গভর্নরের নেতৃত্বে যে সার্চ কমিটি তিনজন প্রার্থীর নাম দিয়েছিল, তাতে শাহীনুল ইসলামের নাম ছিল না। তারপরও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিবেচনায় তিনি নিয়োগ পান। ফলে তাঁর নিয়োগ নিয়েও তখন থেকেই প্রশ্ন উঠেছিল।
অভিযোগের গভীরে: এনা পরিবহন ইস্যু
সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগ হলো এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ব্যাংক হিসাব থেকে অবৈধভাবে টাকা উত্তোলনের অনুমতি। অভিযোগকারীরা বলছেন—
- ওই হিসাবটি সন্দেহজনক লেনদেনের কারণে স্থগিত ছিল।
- বিএফআইইউ প্রধান হিসেবে শাহীনুল ইসলাম নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রায় ১৯ কোটি টাকা তোলার অনুমতি দেন।
- এটি শুধু নিয়মবহির্ভূত নয়, বরং দুর্নীতি ও প্রভাব খাটানোর উদাহরণ।
এই অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে তা সরাসরি অর্থপাচার প্রতিরোধের আইন ভঙ্গ করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাব
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শক্তি অনেক বেশি। একটি ভিডিও বা পোস্ট মুহূর্তেই হাজার হাজার মানুষের কাছে ছড়িয়ে যায়। শাহীনুল ইসলামের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ভিডিওগুলো ছড়িয়ে পড়ার পর সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। অনেকেই মনে করছেন, এমন ঘটনায় দেশের আর্থিক খাতের ওপর আস্থা কমে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে—
- বিএফআইইউ হলো দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা। এর প্রধান যদি অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন, তবে তা দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
- ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (FATF) এর মতো বৈশ্বিক সংস্থা এই ধরনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে।
- ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতার জন্য দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত প্রয়োজন।
সরকারের অবস্থান
সরকারি মহল আনুষ্ঠানিকভাবে খুব বেশি কিছু না বললেও, প্রশাসনিক সূত্র জানায় যে বিষয়টি নজরে রাখা হচ্ছে। কারণ, এটি সরাসরি দেশের অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত।
ভবিষ্যৎ প্রভাব
- প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি: এই ঘটনা বিএফআইইউর ওপর আস্থা কমাতে পারে।
- কর্মকর্তাদের মনোবল: ভেতরের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হতে পারে।
- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: বাংলাদেশ বৈদেশিক লেনদেনে বাড়তি নজরদারির মুখে পড়তে পারে।
- নীতিগত পরিবর্তন: ভবিষ্যতে নিয়োগ ও নজরদারির ক্ষেত্রে কঠোরতা আসতে পারে।
শাহীনুল ইসলামের বাধ্যতামূলক ছুটির ঘটনা কেবল একজন কর্মকর্তার ক্যারিয়ারকে নয়, বরং পুরো দেশের আর্থিক খাতকে নাড়া দিয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে, আর অভিযোগ মিথ্যা হলে সেটিও পরিষ্কারভাবে জানানো উচিত।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক খাতের সুশাসন অত্যন্ত জরুরি। তাই এই ঘটনার সঠিক ও স্বচ্ছ সমাধান দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য অপরিহার্য।
MAH – 12417 , Signalbd.comSEO Short Title