
নারী শিক্ষার প্রসার দাবি করল তালেবান সরকার
আফগানিস্তানে বর্তমানে প্রায় ২৮ লাখ নারী শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে বলে দাবি করেছেন তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলানা আমীর খান মুত্তাকী। তার ভাষ্য অনুযায়ী, দেশে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন প্রায় এক কোটি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ নারী।
রাজধানী কাবুলে “বিজয় দিবস” উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি বলেন,
“আফগানিস্তানে শত শত মাদরাসা ও বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৮ লাখ নারী পড়াশোনা করছে।”
কাবুল বিজয়ের চার বছর
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করলে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসে। মুত্তাকীর ভাষায়,
“কাবুল বিজয় পুরো জাতির বিজয়। আফগান জনগণ খালি হাতে অসংখ্য ত্যাগ স্বীকার করে দেশকে স্বাধীন করেছে। এর ফলে আজ দেশে ইসলামী শরিয়াহ কার্যকর হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “তালেবান সরকার আসার পর অন্যায়, অবিচার ও অস্থিরতার অবসান হয়েছে। দেশে নিরাপত্তা ফিরেছে এবং সাধারণ মানুষ শান্তিতে বসবাস করছে।”
নারী শিক্ষার বাস্তব চিত্র কতটা ভিন্ন?
তালেবান সরকারের দাবি অনুযায়ী নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো ভিন্ন তথ্য তুলে ধরছে। বিবিসি, আল-জাজিরা ও নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর তালেবান ষষ্ঠ শ্রেণির ঊর্ধ্বে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নারীদের প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, আফগানিস্তানে প্রায় ৮০ লাখ নারী ও কিশোরী শিক্ষার বাইরে রয়েছে। এ কারণে তালেবান সরকারের নারী শিক্ষা–সম্পর্কিত বক্তব্য নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কূটনীতি নিয়ে তালেবানের অবস্থান
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকী বলেন, “আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। তবে এর মানে এই নয় যে আমরা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক চাই না। অন্যরা যদি যোগাযোগে দ্বিধাগ্রস্ত হয়, সেটি তাদের সিদ্ধান্ত।”
তিনি দাবি করেন, তালেবান সরকারের কূটনীতিকরা ইতিমধ্যেই কিছু ইউরোপীয় দেশে সফর করেছেন। আফগানিস্তান পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও স্বীকৃতির অভাবে জর্জরিত হলেও কূটনৈতিক পরিসরে নতুন দিগন্ত খুঁজছে।
প্রবাসী আফগানদের প্রতি আহ্বান
মুত্তাকী প্রবাসী আফগানদের দেশে ফেরার আহ্বান জানিয়ে বলেন,
“ভ্রম ও মিথ্যা আশা ত্যাগ করুন। আফগানিস্তান এখন সব আফগানের জন্য অভিন্ন ঘর।”
তিনি দাবি করেন, দেশে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে যারা ভয়ে বা বিভ্রান্তিতে আছেন, তারা ফিরে এলে নিরাপদেই বসবাস করতে পারবেন।
অর্থনীতিতে তালেবানের দাবি
মুত্তাকী বলেন,
“আমাদের সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেট এখন সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব থেকে আসছে। কোনো বিদেশি সহায়তার ওপর আমরা নির্ভর করছি না। ফলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়েছে।”
আফগানিস্তানে বর্তমানে তেল, খনিজ, কৃষি এবং সীমান্ত শুল্ক রাজস্ব সরকারের প্রধান আয়। তবে বিশ্বব্যাংকের মতে, আফগানিস্তানের ৯৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। নারী শ্রমশক্তি প্রায় পুরোপুরি কর্মহীন হয়ে পড়েছে।
সরকারের অর্জন কী কী?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, তালেবান সরকারের প্রধান অর্জনগুলো হলো—
- সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা
- ইসলামী শরিয়াহর বাস্তবায়ন
- দেশব্যাপী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
- ঐক্যবদ্ধ সামরিক বাহিনী গঠন
- ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো ভেঙে দেওয়া
- মাদকবিরোধী অভিযান
- অভ্যন্তরীণ রাজস্ব থেকে বাজেট পূরণ
- আফগানি মুদ্রার স্থিতিশীলতা রক্ষা
তিনি বলেন, “এই অর্জনগুলো আফগানিস্তানকে শক্তিশালী করেছে এবং ইমারাতে ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণ করেছে।”
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
তালেবানের এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি বলেছেন,
“নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে তালেবানের নিষেধাজ্ঞা আফগানিস্তানকে অন্ধকার যুগে ঠেলে দিচ্ছে।”
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও আফগানিস্তানের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে যতদিন না নারী শিক্ষা ও মানবাধিকারে অগ্রগতি দেখা যায়।
তালেবানের প্রতি সাধারণ মানুষের মতামত
আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় অনেকে নিরাপত্তা ফিরে আসায় স্বস্তি প্রকাশ করলেও শহুরে জনগণ নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষুব্ধ। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন নারী অধ্যাপক বলেন,
“২৮ লাখ নারী শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে—এটি একধরনের প্রচারণা মাত্র। বাস্তবে লাখ লাখ মেয়ে বাড়িতে বন্দি।”
বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান
আলোচনা সভায় মুত্তাকীর পাশাপাশি বক্তব্য রাখেন আফগানিস্তানের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী মাওলানা আব্দুস সালাম হানাফী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খলিফা সিরাজুদ্দিন হক্কানী এবং সংস্কৃতি উপমন্ত্রী মাওলানা আতীকুল্লাহ আজিজী। তারা সবাই তালেবান সরকারের অর্জন তুলে ধরেন এবং আফগান জনগণকে সরকারের প্রতি অনুগত থাকার আহ্বান জানান।
তালেবান সরকার দাবি করছে যে, আফগানিস্তানে শিক্ষা ও অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটছে। ২৮ লাখ নারী শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে বলেও জানানো হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছে—যেখানে কোটি নারীর শিক্ষার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
অতএব, তালেবানের বক্তব্য কতটা সত্য এবং কতটা রাজনৈতিক প্রচারণা—তা নিয়ে এখনো বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। আফগান জনগণের জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা কবে আসবে, সেটিই এখন সবার বড় উদ্বেগ।
MAH – 12413 , Signalbd.com