উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। সোমবার (১৮ আগস্ট) দেশের নৌবাহিনীর নতুন যুদ্ধজাহাজ পরিদর্শনের সময় এই ঘোষণা আসে। দেশটির রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম কেআরটি (KRT) বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক মহড়া এবং ক্রমাগত হুমকি উত্তর কোরিয়াকে এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। কিম জং উন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, দেশটির নিরাপত্তা রক্ষা ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে পারমাণবিক শক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।
উত্তর কোরিয়ার এই সিদ্ধান্ত আসছে এমন এক সময়ে যখন ওয়াশিংটন ও সিউল যৌথ সামরিক মহড়া চালাচ্ছে। কিম জং উন এর আগেই এ ধরনের মহড়া “উত্তেজনা সৃষ্টিকারী” বলে সমালোচনা করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, এই মহড়াগুলো মূলত উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আগ্রাসী উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, যা যেকোনো মুহূর্তে বাস্তব যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া এসব মহড়ার প্রতিরক্ষামূলক প্রক্রিয়া দাবি করে আসছে।
পারমাণবিক অস্ত্র বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট
উত্তর কোরিয়া দীর্ঘদিন ধরে পারমাণবিক ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সামরিক শক্তি দৃঢ়ীকরণে জোর দিয়েছে। বিশেষত ২০০৬ সাল থেকে শুরু হওয়া পারমাণবিক পরীক্ষার পর, দেশটি ক্রমশ তার সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিম জং উনের সাম্প্রতিক ঘোষণা শুধু নিরাপত্তার দাবি নয়, এটি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশলও বটে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কিম জং উন ইউরেনিয়াম উৎপাদন ও পারমাণবিক অস্ত্র ইনস্টিটিউট পরিদর্শনকালে একই রকম বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, “উত্তর কোরিয়ার সশস্ত্র বাহিনী এবং পারমাণবিক অস্ত্র সক্ষমতা আন্তর্জাতিক হুমকি মোকাবিলায় অপরিহার্য।” এ কথা প্রমাণ করে যে, দেশের পারমাণবিক নীতি দীর্ঘমেয়াদী এবং ধাপে ধাপে শক্তিশালী করা হচ্ছে।
নৌবাহিনী পরিদর্শন এবং যুদ্ধজাহাজ
সোমবার কিম জং উন নতুন নির্মিত যুদ্ধজাহাজ পরিদর্শন করেন। রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম কেআরটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি জাহাজের প্রযুক্তি, অস্ত্র ব্যবস্থা এবং সেনাদের প্রস্তুতি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেন। কিম জং উন তার পর্যবেক্ষণকালে সতর্ক করেন, “দেশের সামরিক শক্তি এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সবসময় উচ্চ স্তরে থাকতে হবে।”
নির্মিত নতুন জাহাজগুলো মূলত উত্তর কোরিয়ার নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণের অংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এগুলো শুধু প্রতিরক্ষামূলক নয়, সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজনৈতিক বার্তাও বহন করে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষমতা বৃদ্ধির ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক মহলে ইতিমধ্যেই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
- যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া: ওয়াশিংটন বলেছে, তারা পিয়ংইয়ং-এর যে কোনো নতুন পারমাণবিক পদক্ষেপ মনিটর করবে। প্রেস সচিব জানিয়েছেন, “উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।”
- দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিক্রিয়া: সিউল দ্রুত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। তারা কিম জং উনের পদক্ষেপকে ‘প্রত্যক্ষ হুমকি’ হিসেবে দেখছে।
- জাতিসংঘ: নিরাপত্তা পরিষদও বিষয়টি নিয়ে সতর্ক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কার্যক্রম আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, যা ভবিষ্যতে কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে।
সামরিক মহড়া ও উত্তেজনা
বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ সামরিক মহড়া উত্তর কোরিয়ার দৃষ্টিতে স্পষ্ট হুমকি। কিম জং উন বারবার বলেছেন, এ ধরনের মহড়া “উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ায়।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত বৃদ্ধি কেবল প্রতিরক্ষা নয়, এটি কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির একটি হাতিয়ারও। আন্তর্জাতিক মঞ্চে পিয়ংইয়ং-এর অবস্থান দৃঢ় করার জন্য পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল।
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নীতি
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নীতি তিনটি মূল স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আছে:
- সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষা: দেশকে যেকোনো বাহ্যিক হুমকি থেকে রক্ষা করা।
- রাজনৈতিক প্রভাব: পারমাণবিক সক্ষমতা কূটনৈতিক আলোচনায় শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা।
- সামরিক আধুনিকীকরণ: নতুন অস্ত্র, জাহাজ এবং রকেট প্রযুক্তি উন্নয়ন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিম জং উনের সাম্প্রতিক ঘোষণাও এই নীতির ধারাবাহিকতা। এর মাধ্যমে পিয়ংইয়ং নিজেকে কেবল রক্ষিত নয়, বরং আন্তর্জাতিক মঞ্চে সক্রিয় এবং শক্তিশালী প্রমাণ করতে চাচ্ছে।
পূর্ববর্তী পরিস্থিতি
- ২০০৬ সাল থেকে: পারমাণবিক পরীক্ষা শুরু।
- ২০১৭ সালে: দীর্ঘপরিসর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা।
- ২০২৫ সালের জানুয়ারি: ইউরেনিয়াম উৎপাদন ও পারমাণবিক অস্ত্র ইনস্টিটিউট পরিদর্শন।
প্রতিটি ধাপই আন্তর্জাতিক উত্তেজনা এবং санкশন বৃদ্ধি করেছে। তবে কিম জং উন সব সময় তার নীতিতে অটল থেকেছেন।
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে তা প্রভাব ফেলবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিক্রিয়া কেবল সামরিক নয়, কূটনৈতিক চাপও প্রয়োগ করবে।
এছাড়া, পিয়ংইয়ং-এর এই সিদ্ধান্ত সম্ভবত চীনের নজরেও থাকবে। চীন তার প্রতিবেশী দেশটির নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতায় আগ্রহী। তাই চীনের মধ্যস্থতাও আগামির কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
MAH – 12410 , Signalbd.com



