বাংলাদেশ

বাস চালকদের দিতে হয় ‘জিপি চাঁদা’, সিন্ডিকেটের কারণে ফিরছে না সড়কে শৃঙ্খলা

Advertisement

ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলার অভাব যেন চিরচেনা দৃশ্য। প্রতিদিন রাজধানীর ব্যস্ত মোড়ে, বিশেষ করে ভিক্টোরিয়া পার্ক বা পল্টনে গেলে চোখে পড়ে এক অস্বস্তিকর অবস্থা—কচ্ছপ গতিতে চলা বাস, হঠাৎ থেমে অন্যের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া, যাত্রী উঠানো-নামানোর প্রতিযোগিতা। অথচ সড়কে ট্রাফিক পুলিশ ও লাইনম্যান থাকলেও যেন কোনো শৃঙ্খলা নেই।

বাস চালক ও হেলপারদের দাবি, এই বিশৃঙ্খলা তাদের ইচ্ছাকৃত নয়। বরং দিন চুক্তির ভাড়া, অতিরিক্ত গাড়ি এবং প্রতিদিনের বাধ্যতামূলক ‘গেট পাস’ (জিপি) চাঁদাই তাদেরকে বিশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চালাতে বাধ্য করছে।

জিপি চাঁদার বোঝা

একজন বাসচালক জানান, “আমরা চাই না অন্য গাড়ির পথ আটকাতে। কিন্তু আমাদের প্রতিদিন প্রায় ১২,৩০০ টাকা খরচ হয়। তেলের খরচ, স্টাফদের বেতন, আর তার ওপর ৫৫০ টাকা করে জিপি দিতে হয়। এই টাকা না দিলে রাস্তায় গাড়ি চালানোই যায় না।”

ঢাকায় নিবন্ধিত রুট সংখ্যা ১২৮টি। এর মধ্যে ভিক্টর পরিবহনের নিবন্ধিত গাড়ি আছে ১২৯টি। অথচ বাস্তবে রাস্তায় চলে প্রায় আড়াইশোর বেশি গাড়ি। অর্থাৎ নিবন্ধনের বাইরে দ্বিগুণ গাড়ি চলছে সড়কে।

চালকরা জানান, প্রতিদিন ভিক্টোরিয়া পার্ক মোড় বা পল্টন এলাকায় গাড়ি চলার জন্য ৫৫০ টাকা করে দিতে হয়। দুপুরের পর থেকে এই টাকা উঠতে শুরু করে এবং পরে মালিক সমিতির কাছে জমা হয়।

হিসেব বলছে, প্রতিদিন এক রুট থেকেই আদায় হয় প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। বছরে এই অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ৫ কোটি টাকা। ঢাকায় চলা প্রায় ৭ হাজার গাড়ির হিসাবে বছরে জিপি চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় দেড়শো কোটি টাকা

জিপি দিলে ‘সুবিধা’ পাওয়া যায়

চালকরা বলছেন, জিপি দিলে অনেক সুবিধা মেলে। একজন চালক জানান,

“সার্জেন্ট গাড়ি আটকালে সহযোগিতা করেন। দুর্ঘটনা হলেও মামলা না করে মীমাংসা করে দেন। তবে যদি টাকা না দিই, তখন বড় অঙ্কের মামলা করা হয়।”

আরেকজন চালক বলেন, “বাস মালিক সমিতির লোকেরা বলে, জিপি না দিলে গাড়ি বের করা যাবে না। যারা না দেয়, তাদের বাসকে সার্জেন্টরা জব্দ করে।”

টাকা যায় কোথায়?

অনেকে দাবি করেন, জিপি থেকে তোলা অর্থ শুধু মালিক সমিতির ভেতরেই ভাগ হয় না, বরং পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়েও যায়।

একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবহন সংশ্লিষ্ট বলেন,

  • সার্জেন্টদের দিতে হয় ৫০০ টাকা,
  • ট্রাফিক ইন্সপেক্টরদের ১,০০০ টাকা,
  • এডিসিদের ৩,০০০ টাকা,
  • আর ডিসিদের দিতে হয় ৪,০০০ টাকা

অন্যদিকে, মালিক সমিতির ভেতরেও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকলেও চাঁদা ভাগাভাগি নিয়ে সাধারণত সমঝোতা হয়। অনেক সময় ভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্তৃত্ব থাকা সত্ত্বেও সবাই মিলে অর্থ ভাগাভাগি করে নেয়।

মালিক সমিতির বক্তব্য

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বাবুল বলেন,

“এই টাকা আসলে কোম্পানির খরচেই ব্যবহার করা হয়। কর্মকর্তাদের সম্মানী ও লাইনম্যানদের বেতন এখান থেকেই দেওয়া হয়। মাসে প্রায় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা স্টাফ খরচ লাগে।”

তবে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর বড় অংশ আসলে ভাগ-ভাটোয়ারায় চলে যায়। এমনকি কমিটির কিছু সদস্য আছেন, যাদের নিজের নামে কোনো গাড়িই নেই, তবুও তারা জিপির টাকার ভাগ নেন।

সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বহুবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন—ঢাকা শহরে ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ প্রকল্প, নির্দিষ্ট সংখ্যক কোম্পানির আওতায় সব বাস আনা, একক টিকিট সিস্টেম ইত্যাদি। কিন্তু প্রতিবারই মালিক-শ্রমিক সমিতির প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারণে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে।

নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. সালাহউদ্দিন বলেন,

“গেট পাসের নামে টাকা নেওয়ার বোঝা শেষ পর্যন্ত যাত্রীদের ওপরেই পড়ে। সরকার চাইলে আইন প্রয়োগ করতে পারে, কিন্তু মালিক সমিতির প্রভাবের কারণে তা হয় না। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে প্রথমে এই সিন্ডিকেট ভাঙা দরকার।”

যাত্রী ও শ্রমিকদের ভোগান্তি

চালকরা অতিরিক্ত খরচ মেটাতে বাধ্য হন যাত্রীদের কাছ থেকে। এতে ভাড়া বাড়ে, ঝগড়া হয় যাত্রী-হেলপারের সঙ্গে। একই সঙ্গে, চাপের কারণে চালকরা বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালান, দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে।

একজন নিয়মিত যাত্রী জানান,

“প্রতিদিন বাসে চড়লেই ঝগড়া, ধাক্কাধাক্কি, দেরি করে পৌঁছানো। অথচ এর মূল কারণ সিন্ডিকেট। আমরা এর অবসান চাই।”

কেন সমাধান আসছে না?

১. রাজনৈতিক প্রভাব: মালিক সমিতি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, তাই সরকার কঠোর হতে পারে না।
২. আইন প্রয়োগে দুর্বলতা: আইন থাকলেও মাঠপর্যায়ে তা কার্যকর হয় না।
৩. অর্থের লেনদেন: জিপি থেকে আসা অর্থ অনেক পর্যায়ে ভাগ হয়, ফলে কেউ এটি বন্ধ করতে চায় না।
৪. যাত্রীদের সচেতনতার অভাব: যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেও সংগঠিতভাবে চাপ তৈরি করতে পারেন না।

সম্ভাব্য সমাধান

  • বাস রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়ন: নির্দিষ্ট রুটে সীমিত বাস চালানো ও কোম্পানিভিত্তিক সিস্টেমে আনা।
  • ই-টিকিটিং সিস্টেম: নগদ চাঁদার জায়গায় ডিজিটাল টিকিট ব্যবস্থা চালু করা।
  • কঠোর আইন প্রয়োগ: জিপি তোলা বন্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু করা।
  • রাজনৈতিক সদিচ্ছা: সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে সরকার ও রাজনৈতিক দলের আন্তরিক উদ্যোগ দরকার।
  • যাত্রী অধিকার সুরক্ষা আইন: যাত্রীদের স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর আইন তৈরি ও প্রয়োগ।

ঢাকার গণপরিবহনের চেহারা পাল্টানোর দাবি বহু বছরের। কিন্তু প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ও জিপি চাঁদার কারণে আজও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। একদিকে চালকরা অর্থনৈতিক চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন, অন্যদিকে যাত্রীরা প্রতিদিন ভোগান্তি সহ্য করছেন।

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে প্রথমেই সিন্ডিকেট ভাঙা ও জিপি চাঁদা বন্ধ করা জরুরি। আইন থাকলেও প্রয়োগের অভাব এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এই ব্যবস্থা বহাল আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যদি সত্যিই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে চায়, তবে প্রথমেই এই সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।

MAH – 12357 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button