গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কামারদহ ইউনিয়নের রসুলপুর বালুপাড়া গ্রামে চলছে এক অশেষ শোকের মাতম। পরিবারের সচ্ছলতার আশায় সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন সাফিউল ইসলাম (২৬), কিন্তু চাকরি না পেয়ে ও দীর্ঘদিন অনাহারে থেকে প্রাণ হারাতে হলো তাকে। গত ২৮ জুলাই সৌদি আরবের একটি হাসপাতালের গেটে তার মৃত্যু হয়। খবর পাওয়ার পর থেকেই গ্রামের মানুষের চোখে অশ্রু, মুখে শোকের ছায়া।
বিদেশ যাওয়ার প্রেক্ষাপট
সাফিউল ইসলাম ছিলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। দিনমজুর বাবা মো. জলিল শেখের সংসারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। গত বছরের ১ মে স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে সৌদি আরবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে নেন ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ এবং স্থানীয়ভাবে সুদের ওপর আরও ১ লাখ টাকা ধার করেন। দালাল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে সেখানে স্থায়ী চাকরি ও থাকার ব্যবস্থা থাকবে।
সৌদি আরবে পৌঁছে বাস্তব চিত্র
দেশ ছাড়ার সময় সাফিউলের হাতে দেওয়া হয়েছিল একটি পর্যটক ভিসা। ফলে বৈধ কর্মভিসা না থাকায় সৌদি আরবে পৌঁছেই চাকরি খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হন তিনি। বিভিন্ন কোম্পানি ও দোকানে আবেদন করলেও কাগজপত্রের কারণে কোথাও তাকে গ্রহণ করা হয়নি। একপর্যায়ে নিজের সামান্য সঞ্চয়ও শেষ হয়ে যায়। খাবার ও থাকার জায়গা না পেয়ে মসজিদে আশ্রয় নেন, কখনো রাস্তায় আবার কখনো ফ্লাইওভারের নিচে রাত কাটান।
দীর্ঘ অনাহার ও অসুস্থতা
স্থানীয় প্রবাসীদের সহায়তায় কোনো কোনো সময় খাবার পেলেও বেশিরভাগ দিনই সাফিউলকে অনাহারে থাকতে হতো। কয়েক মাসের মধ্যেই তার শারীরিক অবস্থা অবনতি ঘটে। অসুস্থ হলেও টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি। মৃত্যুর আগে প্রায় ১৫ মাস তিনি মানবেতর জীবনযাপন করেছেন বলে জানা যায়।
মৃত্যুর দিন ও পরবর্তী পরিস্থিতি
গত ২৮ জুলাই ভোরে শারীরিক অবস্থা গুরুতর হলে স্থানীয় প্রবাসীরা তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ভর্তি প্রক্রিয়ার আগেই হাসপাতালের গেটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সাফিউল। খবর পৌঁছাতেই গ্রামে শোকের মাতম শুরু হয়। মা মোছা. মহিলা বেগম ও বাবা জলিল শেখ ছেলের মরদেহ আনার জন্য কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন বারবার।
দালালের বিরুদ্ধে অভিযোগ
গ্রামবাসী ও পরিবারের সদস্যরা জানান, একই গ্রামের এক ব্যক্তি নিজেকে সৌদি ফেরত হিসেবে পরিচয় দিয়ে সাফিউলকে চাকরির লোভ দেখিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তার সঙ্গেই গিয়েছিলেন আরও একজন যুবক রনি, যিনি এখনও একই অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ওই দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি, বরং হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
প্রতিবেশী মনির মিয়া বলেন, “আমাদের গ্রামের অনেক তরুণ দালালের প্রলোভনে পড়ে নিঃস্ব হয়েছে। সাফিউলের মৃত্যু তারই এক দৃষ্টান্ত। এর সঠিক বিচার হওয়া দরকার।” স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দালালদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সরকারি সহযোগিতার আশ্বাস
গাইবান্ধা জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারী পরিচালক মো. নেশারুল হক জানিয়েছেন, পরিবারের আবেদনের ভিত্তিতে মরদেহ দেশে আনার জন্য সরকারি সব ধরনের সহায়তা করা হবে। তিনি আরও বলেন, “দালালের মাধ্যমে বিদেশ গেলে এমন ঘটনার ঝুঁকি বেশি থাকে, তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।”
বাংলাদেশে অবৈধ পথে বিদেশ যাত্রার চিত্র
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ দালালের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। অধিকাংশ সময় পর্যটক ভিসা বা ভুয়া কর্মভিসা দিয়ে পাঠানো হয়, যা সেখানে গিয়ে সমস্যার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে চাকরি না পেয়ে অনাহারে থাকেন, আবার কেউ কেউ কারাগারে যান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে না গেলে এমন ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব নয়।
ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা
সাফিউলের মৃত্যু শুধু তার পরিবার নয়, পুরো এলাকার জন্য এক সতর্কবার্তা হয়ে এসেছে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশ যাওয়ার আগে অবশ্যই বৈধ কাগজপত্র নিশ্চিত করা এবং সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে যাওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় জীবনহানি বা আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি থেকে যায়।
গাইবান্ধার সাফিউল ইসলামের বিদেশে মৃত্যুর ঘটনা আবারও প্রমাণ করলো, প্রবাস জীবনের স্বপ্ন যতটা উজ্জ্বল মনে হয়, অবৈধ বা ঝুঁকিপূর্ণ পথে গেলে তা ভয়াবহ পরিণতিতে রূপ নিতে পারে। এখন প্রয়োজন কঠোর নজরদারি, দালাল চক্রের দমন এবং সচেতনতা বৃদ্ধি।
এম আর এম – ০৮৬৪, Signalbd.com

