গত কয়েক মাস ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের গাজ্জা অঞ্চলে যুদ্ধবিরতির পর গাজ্জার পুনর্গঠন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে মিশর। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিন সরকারের অনুগত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণ দিয়ে মিশর গাজ্জায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) ‘মিডল ইস্ট আই’ এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি সরকারের প্রতি আনুগত্যে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদেরকে যুদ্ধ পরবর্তী গাজ্জায় নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক দায়িত্বে সক্ষম করে তুলতে কায়রো বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ফিলিস্তিনি সরকার ও মিশরের সহযোগিতা
ফিলিস্তিনের সরকার প্রধান মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন প্যালেস্টাইন অথোরিটির (PA) অনুগত এই নিরাপত্তাকর্মীরা মিশরের প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন। এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির একটি ধারার অধীনে চলছে, যেখানে মিশর এবং জর্ডান ফিলিস্তিনি পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
মিশর ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার এই যৌথ উদ্যোগ যুদ্ধ পরবর্তী গাজ্জার পুনর্গঠন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি অংশ। এর মাধ্যমে গাজ্জায় নিরাপত্তা ও শাসনব্যবস্থার দায়িত্ব নেওয়ার উপযোগী একটি শক্তিশালী দল গঠন করা হচ্ছে।
প্রশিক্ষণ কর্মসূচির বিস্তৃতি ও বিশদ
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে কায়রোতে অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণে প্যালেস্টাইন অথোরিটির ৩০০ জন নিরাপত্তা কর্মী অংশগ্রহণ করেন। এই দলে ১০০ জন পুলিশ কর্মকর্তা, ১০০ জন জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা, ৫০ জন প্রতিরোধ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং ৫০ জন গোয়েন্দা কর্মকর্তা রয়েছেন।
একজন মিশরীয় নিরাপত্তা সূত্র মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছেন, “প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সবাই ফাতাহ দলের সঙ্গে যুক্ত এবং তারা মাহমুদ আব্বাসের সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত।” মিশর চেষ্টা করছে কায়রোতে এমন কাউকেই অন্তর্ভুক্ত না করতে, যারা মুহাম্মদ দাহলানের প্রতি অনুগত, কারণ পশ্চিম তীরের সরকার এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে এবং সৌদি আরবের সমর্থন লাভ করাও মিশরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও, জর্ডানেও সীমিত সংখ্যক ফিলিস্তিনি নিরাপত্তাকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে যাতে গাজ্জায় নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে।
মিশরের পুনর্গঠন পরিকল্পনা ও এর গুরুত্ব
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজ্জায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানের পর থেকে মিশর গাজ্জার তরুণদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের সক্ষম করে তুলছে। প্রশিক্ষণার্থীদের কেউ কেউ মিশরে বসবাস বা পড়াশোনা করছিলেন, কেউ আবার গাজ্জার বাসিন্দা হলেও পশ্চিম তীরে অবস্থান করতেন। যুদ্ধের কারণে অনেকেই কায়রোতে এসে প্রশিক্ষণে অংশ নেন।
মিশরের কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ২০২৫ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত আরব শীর্ষ সম্মেলনে প্রস্তাবিত মিশরের বৃহত্তর পুনর্গঠন পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো জর্ডানের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনীকে দক্ষ করে গাজ্জায় মোতায়েন করা, যাতে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও আর্থিক সমর্থন সহজে পাওয়া যায় এবং পুনর্বাসন কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বাহিনী নিয়ে প্রস্তাবনা
মিশর এবং সহযোগী দেশগুলোর পক্ষ থেকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে গাজ্জা ও পশ্চিম তীরে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর জন্য। এটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি বড় কাঠামোর অংশ হিসেবে কাজ করবে। তবে এর বাস্তবায়নে অনেক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কারণে।
একটি বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ছাড়া এই সমস্যা সমাধান কঠিন। মিশর মনে করে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক সমঝোতা ও সংলাপের মাধ্যমেই ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
সৌদি আরবের অবস্থান ও আরব-উপসাগরীয় দেশের সমর্থন
তবে মিশরের এই পরিকল্পনা এখনও উপসাগরীয় দেশগুলোর, বিশেষ করে সৌদি আরবের সম্পূর্ণ সমর্থন পায়নি। আরব শীর্ষ সম্মেলনের আগে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিসি গোপন বৈঠকে উপসাগরীয় দেশগুলোকে পরিকল্পনাটি মেনে নিতে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন। মিশরের এই উদ্যোগকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজ্জা পুনর্গঠন পরিকল্পনার বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
তবে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত স্পষ্ট জানিয়েছে, হামাসকে প্রথমে নিরস্ত্র করতে হবে এবং গাজ্জা থেকে তাদের যোদ্ধাদের সরিয়ে দিতে হবে। তার পরই তারা পুনর্গঠন তহবিল ও সমর্থন দিতে প্রস্তুত হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক আলি আল-রাজ্জালের মন্তব্য
ইতালির ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বিশ্লেষক আলি আল-রাজ্জাল বলেছেন, “যদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, তাহলে মিশরের গাজ্জায় প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। মিশর তাদের নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করছে।”
তিনি আরও বলেন, “গাজ্জায় মিশরের নিরাপত্তা উপস্থিতি যত বেশি শক্তিশালী হবে, তত বেশি তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বৃদ্ধি পাবে, যা আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি মিশরের জন্য একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ।”
ফিলিস্তিনের যুদ্ধ পরবর্তী নিরাপত্তা ও পুনর্গঠন কার্যক্রমে মিশরের এই উদ্যোগ মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মিশরের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং আরব-উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সমঝোতা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজ্জার ভবিষ্যত গড়ার ক্ষেত্রে এক নতুন আলো দিচ্ছে। তবে রাজনৈতিক বাধা ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাব এই পরিকল্পনার সফলতার পথে বড় চ্যালেঞ্জ।
আগামী দিনে যদি সকল পক্ষের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়, তাহলে গাজ্জা অঞ্চলের পুনর্গঠন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে মিশরের ভূমিকা এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। এটি শুধুমাত্র ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য নয়, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তির জন্যও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
MAH – 12290 , Signalbd.com



