
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের টানা ভারি বর্ষণের প্রভাবে তিস্তা নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার (১৩ আগস্ট) সকাল ৬টায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) রেকর্ড অনুযায়ী এ পয়েন্টে পানির উচ্চতা ৫২ দশমিক ২২ মিটার, যা স্থানীয়দের মধ্যে নতুন করে বন্যা আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
ডালিয়া ডিভিশনের উপসহকারী প্রকৌশলী তহিদুল ইসলাম জানান, গত কয়েকদিনের লাগাতার বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে আসা পানির প্রবাহ হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। ফলে তিস্তার দুই পাড়ের নিম্নাঞ্চল ও চরগ্রামগুলোতে ইতোমধ্যেই পানি ঢুকে পড়েছে।
তিস্তার পানি বৃদ্ধির কারণ
১. উজানের ভারি বর্ষণ — ভারতের সিকিম, দার্জিলিং ও আশপাশের পাহাড়ি অঞ্চলে কয়েকদিন ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে।
২. পাহাড়ি ঢল — বর্ষণের কারণে পাহাড়ি ঢল দ্রুত তিস্তা নদীতে নেমে আসছে।
৩. অব্যাহত পানি প্রবাহ — তিস্তার উজানের বাঁধ ও ব্যারাজ থেকে অতিরিক্ত পানি ছাড়া হচ্ছে, যা বাংলাদেশের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিস্তা ব্যারাজে জরুরি ব্যবস্থা
বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ডালিয়া ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইসগেট পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়েছে।
পাউবো কর্মকর্তা অমিতাভ চৌধুরী বলেন,
“গতকাল সারাদিন পানি বিপৎসীমার নিচে ছিল। আজ সকাল থেকে এটি ৭ সেন্টিমিটার ওপরে গেছে। আমরা সতর্কাবস্থায় আছি এবং সব স্লুইসগেট খোলা রেখেছি, যাতে অতিরিক্ত পানি দ্রুত নেমে যেতে পারে।”
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা
তিস্তার পানি বৃদ্ধির ফলে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে:
- পূর্ব ছাতনাই
- খগাখাড়িবাড়ী
- টেপাখড়িবাড়ী
- খালিশা চাপানী
- ঝুনাগাছ চাঁপানী
- গয়াবাড়ী
এছাড়া জলঢাকার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ী, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়ন পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে, এ পর্যন্ত প্রায় ৫,০০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
স্থানীয়দের দুর্ভোগ
পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান বলেন,
“সবচেয়ে বড় চর গ্রাম ঝাড়সিংশ্বরসহ আশপাশের কয়েকটি চর এলাকায় বন্যার পানি ঢুকেছে। ফসলি জমি ডুবে গেছে, গবাদিপশু নিয়ে মানুষ বিপাকে পড়েছে।”
অনেক পরিবার ঘরের জিনিসপত্র, ধান-গমের বীজ ও গবাদিপশু নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে।
লালমনিরহাটেও প্রভাব
তিস্তার পানি বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে হাতিবান্ধা ও কালিগঞ্জ উপজেলায়। নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলে হাঁটু সমান পানি ঢুকে পড়েছে।
- অনেকে ছোট নৌকা ব্যবহার করে চলাফেরা করছেন।
- রাস্তা-ঘাটের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।
তিস্তার ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট ও বন্যার ইতিহাস
তিস্তা নদী ভারতের সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে নীলফামারী ও লালমনিরহাট হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়।
- দৈর্ঘ্য প্রায় ৪১৫ কিলোমিটার।
- তিস্তা ব্যারাজ (ডালিয়া পয়েন্ট) নির্মাণ হয় ১৯৯০ সালে।
- বিগত বছরগুলোতে (২০১৭, ২০২০ ও ২০২২) এই এলাকায় ভয়াবহ বন্যা হয়েছে।
আশঙ্কা ও সরকারি প্রস্তুতি
পাউবো কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উজানের পানি প্রবাহ অব্যাহত থাকলে সন্ধ্যার মধ্যে আরও পানি বাড়তে পারে।
- জেলা প্রশাসন জরুরি ত্রাণ প্রস্তুত রেখেছে।
- আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে, তবে এখনো পূর্ণাঙ্গ সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়নি।
- স্বেচ্ছাসেবীরা নৌকায় করে পানিবন্দি এলাকায় খাবার ও ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছেন।
বর্তমান পরিস্থিতির পরিসংখ্যান
এলাকা | ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার | পানির উচ্চতা | স্লুইসগেট খোলা |
---|---|---|---|
নীলফামারী | ৫,০০০+ | বিপৎসীমার ৭ সেমি ওপরে | ৪৪টি |
লালমনিরহাট | শতাধিক গ্রাম | হাঁটু সমান | আংশিক প্রভাব |
স্থানীয়দের ভয় ও প্রত্যাশা
স্থানীয় কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন,
“এই সময়টায় আমাদের জমিতে আমন ধানের চারা থাকে। যদি পানি আরও বাড়ে, তাহলে সব নষ্ট হয়ে যাবে।”
অন্যদিকে লালমনিরহাটের গৃহিণী রাশিদা খাতুন বলেন,
“ঘরের ভেতর পানি উঠছে। শিশুদের নিয়ে কীভাবে থাকব বুঝতে পারছি না। আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে গবাদিপশুর কী হবে, সেটাই বড় চিন্তা।”
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধির পেছনে শুধু মৌসুমি বৃষ্টিপাত নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তনও দায়ী।
- অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের হার বৃদ্ধি
- বরফ গলার সময় পরিবর্তন
- নদীর প্রবাহে অনিয়মিততা
তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে ওঠায় নীলফামারী ও লালমনিরহাটের কয়েক হাজার মানুষ বিপদে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিতে পারে। কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং জরুরি সহায়তা প্রস্তুত রেখেছে। তবে, স্থানীয়দের এখনই সতর্ক হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
MAH – 12285 , Signalbd.com