যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের বুকে নতুন এক কৃষি বিপ্লব শুরু করেছেন তিন তরুণ বাংলাদেশি। চাকরি কিংবা রেস্তোরাঁ ব্যবসার সলিউশন ছেড়ে, তারা লন্ডনের অচেনা মাটিতে ‘দেশি সবজি’ চাষের মাধ্যমে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
হাবিবুর রহমান, আবদুল রাজ্জাক ও ইমদাদুল বাশার—তিনজন মিলে ২০২৩ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে দেশি সবজির চাষ করছেন লন্ডনের উপকণ্ঠে। তাদের এই উদ্যোগের নাম ‘ফ্রেশ কৃষি’।
লন্ডনে দেশি সবজি চাষ: শখ থেকে স্বপ্নের বাস্তবায়ন
সাধারণত যুক্তরাজ্যে প্রবাসীরা শখের বসে গ্রীষ্মকালে নিজেদের বাড়ির ছাদ বা আঙিনায় কিছু সবজি চাষ করেন। কিন্তু বাণিজ্যিক চাষ ও বড় পরিসরে দেশি সবজির চাষ কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি—কারণ রয়েছে কঠিন আবহাওয়া, উপযুক্ত জায়গার অভাব এবং বাজারজাতকরণের সমস্যা।
তবে এই তিন যুবক এই সকল চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে লন্ডনের হারলো এলাকায় প্রায় এক একর আয়তনের একটি গ্রিনহাউস ভাড়া নিয়ে দেশি সবজি চাষ শুরু করেছেন।
শুরুটা কেমন ছিল?
হাবিবুর রহমান ও আবদুল রাজ্জাকের বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং, আর ইমদাদুল বাশার মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার ছেলে। দীর্ঘ দিন ইতালিতে ছিলেন তারা; পরবর্তীতে লন্ডনে এসে স্থায়ীভাবে বসতি গড়েন।
হাবিবুরের ইতালিতে পারিবারিক সবজিবাগান ছিল। লন্ডনে এসে দোকান থেকে কেনা সবজি দেখে তিনি হতাশ হন কারণ তা বেশিরভাগ সময় পুরোনো ও ঝাপসা। দেশে গড়ে ওঠা তাজা সবজির স্বাদ পেতে না পারায় হাবিবুর রাজ্জাক ও ইমদাদুলকে নিয়ে উদ্যোগ নেন দেশের মতো শাকসবজি চাষ করার।
বিনিয়োগ থেকে ব্যবসায় সফলতার গল্প
তিন উদ্যোক্তা ২০২৩ সালে প্রায় এক লাখ পাউন্ড (প্রায় ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা) বিনিয়োগ করে বাণিজ্যিক সবজি চাষ শুরু করেন। মাত্র তিন বছরের মধ্যে তাদের ‘ফ্রেশ কৃষি’ ব্যবসার মূল্য দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ পাউন্ড বা প্রায় ৯ কোটি ৮১ লাখ টাকার আশেপাশে।
২০২৫ সালের চলতি মৌসুমেই তারা গত তিন মাসে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডের (৪ কোটি ৯ লাখ টাকা) সবজি বিক্রি করেছেন। মৌসুম শেষে লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ পাউন্ড বা ৮ কোটি ১৮ লাখ টাকার কাছাকাছি।
কী চাষ করছেন তারা?
‘ফ্রেশ কৃষি’ খামারে লাউ, শিম, বরবটি, ধনেপাতা, শর্ষে, মেথি, মুলাশাক, কলমিশাক, পুঁইশাক, বেগুন, করলা, ঢ্যাঁড়স, কাঁকরোলসহ নানা দেশি সবজির চাষ করা হয়।
আবহাওয়া এবং প্রযুক্তির বাধা: গ্রিনহাউসের প্রয়োজনীয়তা
যুক্তরাজ্যের ঠাণ্ডা ও পরিবর্তনশীল আবহাওয়া দেশি সবজি চাষের জন্য খুব একটা উপযোগী নয়। তাই তারা গ্রিনহাউস ব্যবহারের পথে এগিয়েছেন।
হাবিবুর বলেন, “ব্রিটিশ শসার জন্য তৈরি গ্রিনহাউসকে দেশি সবজির জন্য মানিয়ে নিতে প্রথমে অনেক বেগ পেতেছি। আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ, স্বয়ংক্রিয় সেচব্যবস্থা ও যন্ত্রপাতি নতুন করে তৈরি করেছি।”
অন্যদিকে, আবদুল রাজ্জাক বলেন, “সরকারি কোনো প্রশিক্ষণ পাইনি, পুরোপুরি নিজেদের জ্ঞান ও বাংলাদেশ থেকে ফোনে কৃষিবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে কাজ করছি।”
কীটনাশক ছাড়াই সবজি উৎপাদন: স্বাস্থ্য ও গুণগতমানের প্রতি লক্ষ্য
‘ফ্রেশ কৃষি’ খামারে কোনো ধরনের ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। কেবল প্রয়োজনীয় সার দেওয়া হয়। ফলে সবজিগুলো বেশি স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ হয়।
নিজ হাতে কাজ: অভিজ্ঞ কর্মীর অভাব বড় চ্যালেঞ্জ
দক্ষ শ্রমিকের অভাবে শুরু থেকেই তিন উদ্যোক্তা নিজ হাতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করছেন। ইমদাদুল বাশার জানান, প্রথম বছর লাভ হয়নি, তবে লোকসানও হয়নি।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও আকাঙ্ক্ষা
তিন উদ্যোক্তা ভবিষ্যতে ‘ফ্রেশ কৃষি লিমিটেড ইউকে’ কে ১ মিলিয়ন পাউন্ড বা প্রায় ১৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ব্যবসায় পরিণত করার লক্ষ্য রাখছেন।
তার জন্য তারা বড় পরিসরে নিজেদের গ্রিনহাউস নির্মাণ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চান।
স্থানীয় ও প্রবাসী বাংলাদেশির চাহিদা মেটাতে কাজ
‘ফ্রেশ কৃষি’র প্রধান গ্রাহক পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশি সম্প্রদায়। তবে চাহিদার তুলনায় তারা মাত্র ১ শতাংশই সরবরাহ করতে পারছেন। তাই বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা অনেক।
চ্যালেঞ্জ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা
- দক্ষ শ্রমিকের অভাব
- স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সীমিত প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা
- আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও প্রযুক্তি উন্নয়ন
হাবিবুর বলেন, “অনেকে যুক্তরাজ্যে এসে আমাদের খামারে কাজ করতে চান, কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে টিকে থাকছেন না। এজন্য স্থানীয় প্রশিক্ষণ জরুরি।”
প্রবাসীদের জন্য অনুপ্রেরণা
এই তিন বাংলাদেশি যুবকের গল্প প্রমাণ করে, সাহস, কঠোর পরিশ্রম ও সঠিক পরিকল্পনা থাকলে দেশের বাইরে থেকেও কৃষি ও ব্যবসায়ে সফল হওয়া সম্ভব।
তারা শুধু নিজেরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন না, বরং যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতেও অবদান রাখতে চাইছেন।
সরকারের কাছে আবেদন
তারা সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন— কৃষি খাতে বিশেষ প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহযোগিতা ও উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণের সুযোগ দেয়া হোক। এর মাধ্যমে প্রবাসীরা তাদের উদ্যোগকে আরো শক্তিশালী করে দেশের নাম উজ্জ্বল করতে পারবেন।
লন্ডনে বাণিজ্যিক দেশি সবজি চাষের এই সফল উদ্যোগ প্রমাণ করছে, সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জকে জয় করে স্বপ্ন পূরণ সম্ভব। বাংলাদেশের যুবকরা নতুন অধ্যায় রচনা করছেন, যেখানে কৃষি ও প্রবাস জীবন একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
MAH – 12267 , Signalbd.com



