
মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাস দমনে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবের যৌথ অভিযান—দুই ঘণ্টায় বড় ধরনের অভিযান, উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি
রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরের কুখ্যাত জেনেভা ক্যাম্পে সোমবার (১১ আগস্ট ২০২৫) রাতে যৌথবাহিনী এক ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করেছে।
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত এ অভিযানে পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা অংশ নেন।
অভিযানটি রাত ৮টা থেকে শুরু হয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে। দুই ঘণ্টার এই তল্লাশি ও গ্রেপ্তার অভিযানে ধরা পড়েছে বহু মাদক, ধারালো অস্ত্র এবং সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীরা। মোট ১৪ জনকে আটক করা হয়, যাদের মধ্যে অন্যতম কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী নাসিম।
অভিযানের পটভূমি
সোমবার সকালেই জেনেভা ক্যাম্পে মাদক বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে শাহ আলম (৪২) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং সহিংসতা আরও বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
সংঘর্ষের পর এলাকাবাসী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন, কারণ মাদক ব্যবসা ও অপরাধী কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে এই ক্যাম্পকে ঘিরে রেখেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিহত শাহ আলম মূলত এক সময় মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন, পরে তা ছেড়ে দেন। তবে মাদক সিন্ডিকেটের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে তিনি হামলার শিকার হন।
অভিযানে যা উদ্ধার হয়েছে
যৌথবাহিনী অভিযানের সময় পুরো জেনেভা ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। প্রবেশ ও বের হওয়ার পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। সন্দেহভাজন যে কাউকে তল্লাশি করা হয়।
অভিযান শেষে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়—
- অস্ত্র: ৮টি ধারালো চাপাতি
- মাদক: উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অবৈধ মাদকদ্রব্য (ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন)
- মদ: ৪টি বিদেশি মদের বোতল
- অন্যান্য: ৬৮টি মোটরসাইকেল হেলমেট (যা অপরাধী কার্যক্রমে ব্যবহৃত হতে পারে)
অভিযান চলাকালে আটককৃতদের মধ্যে কেউ কেউ মাদক ব্যবসায়ী, কেউ সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য এবং কেউ এলাকায় চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।
জেনেভা ক্যাম্প: অপরাধের ঘাঁটি?
মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান থেকে আসা বিহারিদের জন্য গঠিত হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে এটি ঘনবসতিপূর্ণ এক বস্তিতে পরিণত হয়েছে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ায় এখানে বহু বছর ধরে মাদক, অস্ত্র ব্যবসা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজি চলে আসছে।
এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রতিদিনই এখানে গোপনে মাদক কেনাবেচা হয়, রাতের বেলা মোটরসাইকেল গ্যাং চলাফেরা করে এবং বাইরের অপরাধীরা এখানে আশ্রয় নেয়। পুলিশের তৎপরতা থাকলেও শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয়নি।
যৌথবাহিনীর ভূমিকা
যৌথবাহিনী (সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ) সাধারণত বড় ধরনের অপরাধ দমন বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একসাথে অভিযান চালায়। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি অপরাধীদের উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে এবং দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করে।
অভিযান শেষে যৌথবাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন—
“জেনেভা ক্যাম্প দীর্ঘদিন ধরে অপরাধের জন্য কুখ্যাত। আমরা চেষ্টা করছি এখানে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চিরতরে বন্ধ করতে। নিয়মিত অভিযান চলবে।”
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয়দের অনেকেই যৌথবাহিনীর এই অভিযানে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
এক বাসিন্দা জানান—
“আমরা প্রতিদিন ভয়ে থাকি। বাচ্চাদের বাইরে খেলতে দেই না। আজকের অভিযানে আমরা খুশি, আশা করি এ ধরনের অভিযান চলবে।”
তবে কিছু বাসিন্দা অভিযোগ করেছেন, অভিযানের সময় নিরপরাধ ব্যক্তিরাও হয়রানির শিকার হন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চ্যালেঞ্জ
জেনেভা ক্যাম্পে অপরাধ দমনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—
- ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, যেখানে অপরাধী সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে।
- অপরাধ চক্রের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনীতিবিদদের যোগাযোগের অভিযোগ।
- মাদক ব্যবসার বিশাল নেটওয়ার্ক, যা শুধু এই এলাকায় নয়, পুরো ঢাকায় ছড়িয়ে আছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, তারা গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াবে এবং এলাকায় নিয়মিত টহল চালাবে।
পূর্বের অভিযানসমূহ
এর আগেও জেনেভা ক্যাম্পে র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনী একাধিকবার অভিযান চালিয়েছে।
২০১৯ সালে এক অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার হয়েছিল।
২০২৩ সালে র্যাবের অভিযানে ২০ জন গ্রেপ্তার হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিল মোটরসাইকেল গ্যাং সদস্য।
তবুও অপরাধ পুরোপুরি নির্মূল হয়নি, যা এই এলাকার গভীর সমস্যার ইঙ্গিত দেয়।
ভবিষ্যৎ করণীয়
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু অভিযান চালিয়ে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন—
- দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন পরিকল্পনা
- এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি
- যুব সমাজকে মাদক থেকে দূরে রাখতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম
- অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয় বন্ধ করা
মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে যৌথবাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযান দেখিয়েছে যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধ দমনে কঠোর অবস্থানে আছে। তবে এই সমস্যার সমাধান শুধু অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার নয়—প্রয়োজন সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, যাতে অপরাধের মূল শেকড় উপড়ে ফেলা যায়।
MAH – 12265 , Signalbd.com