
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে চলন্ত মাইক্রোবাস খালে পড়ে একই পরিবারের সাতজনের মর্মান্তিক মৃত্যু দেশজুড়ে শোকের ছায়া ফেলেছে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অনেকেই জানতে চাচ্ছেন— এমন পরিস্থিতিতে পড়ে গেলে কীভাবে জীবন রক্ষা করা সম্ভব? বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক এবং দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. এম শামসুল হক জানালেন, কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এবং কোন ভুলগুলো একেবারেই করা যাবে না।
পানিতে পড়লে গাড়ি সঙ্গে সঙ্গে ডুবে যায় কি?
অনেকের ধারণা, পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি ডুবে যায়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ এয়ারকন্ডিশনযুক্ত গাড়ি কিছু সময় ভেসে থাকে। সাধারণত ৩০ সেকেন্ড থেকে ২ মিনিট পর্যন্ত সময় পাওয়া যায়, যেখানে যাত্রীরা সঠিক পদক্ষেপ নিলে প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব। এই সময়টাকেই বলা হয় ‘গোল্ডেন টাইম’। এসময় ভুল সিদ্ধান্ত বা আতঙ্কে সময় নষ্ট করলে পরিণতি হতে পারে মারাত্মক।
দুর্ঘটনার বাস্তব চিত্র: অতীত ঘটনার বিশ্লেষণ
নোয়াখালীর ঘটনার মতো অতীতে আরও অনেক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
২০১৯ সালে পাবনায় একটি প্রাইভেট কার ব্রিজ থেকে পড়ে নদীতে তলিয়ে যায়, মারা যান পাঁচজন। ২০২১ সালে মুন্সীগঞ্জে খালে পড়ে চারজনের মৃত্যু হয়। একইভাবে ২০২৩ সালে কক্সবাজারের পাহাড়ি সড়কে গাড়ি পড়ে তিনজন মারা যান। প্রতিটি ঘটনার একটি সাধারণ দিক ছিল— গাড়ির জানালা খুলতে না পারা এবং দ্রুত বের হয়ে আসতে না পারা।
কীভাবে জীবন বাঁচানো সম্ভব? বিশেষজ্ঞের চার ধাপ
বিশেষজ্ঞরা জীবন বাঁচানোর জন্য চারটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ মনে রাখার পরামর্শ দেন। ইংরেজিতে এই ধাপগুলোকে বলা হয় SSWG:
১. Stay Calm (স্থির থাকুন)
ভয়ের সময় চিৎকার, অস্থিরতা এবং হড়বড় করে কাজ করলে অক্সিজেনের অপচয় হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কমে যায়। তাই প্রথমেই নিজেকে স্থির রাখুন।
২. Seat Belt খুলুন
দ্রুত নিজের ও আশেপাশের যাত্রীদের সিটবেল্ট খুলুন। অনেকে সিটবেল্ট আটকে থাকার কারণে গাড়ির ভেতরে আটকে পড়ে মারা যান।
৩. Window খুলুন
গাড়ি পানিতে পড়ার পর প্রথম ৩০-৬০ সেকেন্ডে পাওয়ার উইন্ডো সাধারণত কাজ করে। তাই সময় নষ্ট না করে উইন্ডো খুলে বের হওয়ার চেষ্টা করুন। দরজা খোলা প্রায় অসম্ভব, কারণ পানির চাপ বাইরে থেকে অনেক বেশি থাকে। উইন্ডো খুলে না গেলে, গ্লাস ভাঙার চেষ্টা করতে হবে।
বিশেষ টিপস: সামনের উইন্ডো সাধারণত নিরাপত্তা গ্লাসের হয়, যা ভাঙা কঠিন। তাই পেছনের সাইড উইন্ডো ভাঙতে চেষ্টা করুন। হেডরেস্টের ধাতব অংশ বা স্পেশাল উইন্ডো ব্রেকার ব্যবহার করলে সহজে ভাঙা সম্ভব।
৪. Go Out Immediately (দ্রুত বেরিয়ে পড়ুন)
গাড়ি ভেসে থাকবে এমন আশায় বসে থাকবেন না। যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে আসুন এবং অন্যদের বের করতে সাহায্য করুন। সময়ই এখানে সবচেয়ে বড় বিষয়।
শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে করণীয়
গাড়িতে শিশু বা বৃদ্ধ থাকলে আগে নিজের জানালা খুলে নিন, যেন বাতাস ঢুকতে পারে। এরপর একে একে অন্যদের বের করতে হবে। নিজে আগে বের হয়ে তাদের সাহায্য করাই বেশি কার্যকরী।
গাড়ির সঙ্গে পানিতে ডুবে গেলে দরজার চেষ্টা নয়, জানালাই বাঁচার পথ
পানির গভীরতায় গাড়ির দরজা খোলা প্রায় অসম্ভব। অনেকে সময় নষ্ট করেন দরজা খোলার চেষ্টা করে। এটি প্রাণঘাতী হতে পারে। জানালাই হলো নিরাপদ বের হওয়ার পথ।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, “নন-এসি বা জানালাগুলো যেসব গাড়িতে সহজে খোলা যায়, সেসব যান পানিতে পড়লেও প্রাণহানি তুলনামূলক কম হয়। কারণ জানালা দিয়ে বের হওয়া সহজ হয়।”
গাড়িতে থাকা উচিত জরুরি সরঞ্জাম
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিটি গাড়িতে একটি লাইফ হ্যামার বা উইন্ডো ব্রেকার থাকা উচিত। এই সরঞ্জামগুলো ছোট, হালকা এবং জরুরী সময়ে জানালা ভাঙতে সহায়ক। গ্লাভবক্সে বা গাড়ির দরজার পাশে এটি রাখা যেতে পারে।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতা ও মানসিক প্রস্তুতি জরুরি
এই ধরনের দুর্ঘটনা কেবল দুর্ভাগ্য নয়, অনেক সময় তা প্রস্তুতির অভাবে ঘটে। গাড়িতে বসার পর জানালার অবস্থান, সিটবেল্ট, এবং আশেপাশের যাত্রীদের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা রাখা উচিত। মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকলে এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে জীবন বাঁচানো সম্ভব।
শেষ কথা
একটি চলন্ত গাড়ি পানিতে পড়ে গেলে বাঁচার সময় মাত্র কয়েক সেকেন্ড থেকে এক–দুই মিনিট। এই সময়টাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে প্রাণহানি প্রায় নিশ্চিত। তাই আগেভাগে সচেতনতা ও প্রস্তুতি জরুরি। নিজেকে জানালার দিকে রাখুন, লাইফ হ্যামার সঙ্গে রাখুন, এবং পরিবারের সবাইকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিন। ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলে আপনি এবং আপনার প্রিয়জন যেন নিরাপদে ফিরে আসতে পারেন।
এম আর এম – ০৭২১, Signalbd.com