জুলাই ঘোষণাপত্রে শাপলা চত্বরের ঘটনা না আসায় হতাশ হেফাজতে ইসলাম

জুলাই ঘোষণাপত্রে ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের গণসংগ্রামের স্মরণীয় ঘটনার উল্লেখ না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছে হেফাজতে ইসলাম। মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে ঘোষণাপত্র পড়ার পর হেফাজতের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ হাবিব এ প্রতিক্রিয়া জানান।
জুলাই ঘোষণাপত্রের বিস্তারিত ও হেফাজতের প্রতিক্রিয়া
অন্তর্বর্তী সরকারের জুলাই ঘোষণাপত্রে ২৮টি দফা স্থান পেয়েছে। এতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের বিষয়বস্তু উঠে এসেছে। তবে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে ঘটে যাওয়া নৃশংস হামলার ঘটনা ঘোষণাপত্রে না থাকায় সংগঠনটি গভীরভাবে হতাশ।
হেফাজতের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ হাবিব বলেন, “শাপলা চত্বরের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। সেখানে এক রাতে লক্ষাধিক গুলিচালনার মাধ্যমে নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর ন্যাশনালিজমের নামে বর্বরোচিত নির্যাতন চালানো হয়েছিল। হাজার হাজার আলেম-ওলামা প্রাণ হারিয়েছে। এই ইতিহাসের উল্লেখ যদি হয়, তা হলে দেশের তরুণ প্রজন্ম সত্যিকারের দেশের ইতিহাস জানতে পারত।”
তিনি আরও বলেন, “জুলাই ঘোষণাপত্রের অনুষ্ঠানের শুরুতেই কোরআন তেলাওয়াত না হওয়ায় ৯২ শতাংশ মুসলিম জাতির অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। ধর্মীয় মর্যাদা ও ইতিহাসকে সম্মান দিতে হবে, যা এ ঘোষণাপত্রে অনুপস্থিত।”
শাপলা চত্বরের ঘটনা: এক প্রেক্ষাপট
২০১৩ সালের ৫ মে, ঢাকা শহরের মতিঝিল এলাকায় শাপলা চত্বর ছিল হেফাজতে ইসলামের একটি বড় সমাবেশের স্থান। ওইদিন রাতের অন্ধকারে সরকার বাহিনী ও পুলিশ এক নৃশংস অভিযান চালায়, যেখানে টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ, এবং গুলিবর্ষণের মাধ্যমে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ আহত ও নিহত হয়। এই ঘটনা তখন সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন বিষয়টি তদন্তের আহ্বান জানায়।
হেফাজতের আন্দোলনকারীরা এটিকে দেশপ্রেমিক আন্দোলন বলে মনে করেন, যেখানে ইসলামি শিক্ষাবিদ ও ছাত্র সমাজ ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য দাঁড়িয়েছিল। তবে এ ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে নানাভাবে খণ্ডন করা হলেও, আজও এই ঘটনা দেশের রাজনৈতিক বৃত্তে আলোচনার প্রধান বিষয়।
জুলাই ঘোষণাপত্র ও দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
অন্তর্বর্তী সরকার চলাকালীন সময়ে প্রকাশিত এই জুলাই ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র পুনঃস্থাপন, নির্বাচন ও মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ নিয়ে ব্যাপক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ২৮ দফার মধ্যে বেশিরভাগ বিষয় নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমাজকর্মীরা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
তবে হেফাজতের মতো গুরত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর দাবি বা ইতিহাস থেকে একটি বড় অধ্যায় বাদ পড়ার বিষয়টি রাজনৈতিক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার জন্য এই ধরনের ঘটনাগুলো স্বীকৃতি থাকা অত্যন্ত জরুরি।
রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের সময় বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, নাগরিক ঐক্যসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তারা বলেছিলেন, এই ঘোষণাপত্র দেশের জন্য একটি ইতিবাচক ধাপ হতে পারে। কিন্তু শাপলা চত্বরের ঘটনা বাদ পড়া নিয়ে হেফাজতের মতো ধর্মীয় সংগঠনের অসন্তোষ রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
হেফাজত নেতারা তাদের অবস্থান দৃঢ় করেছেন এবং দাবি করেছেন, আগামী দিনে দেশের ইতিহাস ও মানুষের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
বিশেষজ্ঞ মতামত ও বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শাপলা চত্বরের ঘটনা জাতীয় রাজনৈতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তা যদি জাতীয় নীতিমালার একটি প্রধান দফায় অন্তর্ভুক্ত না হয়, তাহলে সেটি দেশের সামাজিক ঐক্য ও ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা আরও মন্তব্য করেন, রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র বা নীতিমালায় সব সম্প্রদায় ও ইতিহাসের সম্মান বজায় রাখা জরুরি, যাতে দেশের সকল অংশীজন স্বীকৃত বোধ করেন।
সারসংক্ষেপ
জুলাই ঘোষণাপত্রে শাপলা চত্বরের ঘটনা না থাকার বিষয়টি হেফাজতের পক্ষ থেকে গভীর হতাশার সৃষ্টি করেছে। এটি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক বিষয় নয়, বরং দেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়েরও প্রশ্ন। ভবিষ্যতে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও স্মৃতিচারণ অন্তর্ভুক্ত করে আরও সমন্বিত জাতীয় নীতিমালা গড়ে তোলা গেলে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা দৃঢ় হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আগামী দিনে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার দরজা বন্ধ নয়, বরং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাধান খোঁজা হবে দেশের জন্য।
এম আর এম – ০৭১৩, Signalbd.com